Monday, October 3, 2011

Durga Puja of Midnapur

মেদিনীপুর

পরমানন্দপুরের ঘোষ পরিবারের দুর্গাপুজো - দেবাশিষ বন্দ্যোপাধ্যায়







পুজোর শুরু

১২০৯ সালের ঘটনা। গৃহদেবতা থাকায় আলাদা মণ্ডপ করা যাবে না। আবার বাঙালির সবচেয়ে বড় উৎসব দুর্গা পুজো, তাও করতে হবে। কিন্তু কী ভাবে? পুরোহিতেরা বিধান দিলেন, গৃহদেবতার মন্দিরেই মাটির ‘ঘট’-কে দেবী দুর্গা রূপে পুজো করা হবে। সেই থেকে পুরুষানুক্রমে গৃহদেবতা রঙ্কিনী মাতার মন্দিরে এ ভাবেই দুর্গাপুজো করে আসছেন পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার চন্দ্রকোনা থানা এলাকার পরমানন্দপুর গ্রামের ঘোষ পরিবার। এখনও সেই রীতির কোনও পরিবর্তন ঘটেনি।

পুজোর বৈশিষ্ট্য

যদুনাথ ঘোষের চালু করা এই পুজোর এক একটি দিনের বিশেষত্ব এক এক রকম। ঘোষ বংশের সুশীল ঘোষ, রাজকুমার ঘোষেরা বলেন, “বংশ পরম্পরায় এ ভাবেই পুজো চলে আসছে। পুজোর আচার-আচরণে কোনও পরিবর্তন হয়নি। পুজো হয় পুরনো রীতি মেনেই।”

পুজো শুরু হয় প্রতিপদ অর্থাৎ মহালয়ার পর দিন থেকে। সে দিনই ঘট বসানো হয় মন্দিরে। পুকুর থেকে ঘট মাথায় করে রঙ্কিনী মন্দিরে নিয়ে যান পুরোহিত। তার সঙ্গে থাকে ঢাকের বাদ্যি, শঙ্খধ্বনি, উলুধ্বনি। সেই দিন থেকেই প্রতিদিন চণ্ডীপাঠ হত আগে। বর্তমানে অবশ্য পুজোর ক’দিনই চণ্ডীপাঠ হয়। ষষ্ঠীতে হয় বেলবরণ। পুকুরের ধারেই রয়েছে একটি বেল গাছ। সেই বেলগাছকে দেবী রূপে পুজো করা হয়। সপ্তমীতে কলাবউ স্নান। শিকড়-সহ কলাগাছ তুলে নিয়ে আসা হয়। সুন্দর হলুদ শাড়ি পরানো হয়। কেবল ঘোষ পরিবারের সদস্যরাই নন, গ্রামের পুরুষ, মহিলারা সুসজ্জিত হয়ে কলাবউকে স্নান করাতে নিয়ে যান। পুরোহিতের হাতে থাকে কলাবউ। শোভাযাত্রার প্রথমেই থাকেন পুরোহিত। অষ্টমীতে সন্ধিপুজো। এই দিনটি সকলের কাছেই অতি রোমাঞ্চকর। কারণ, এক কোপে চারটে পাঁঠা বলি হয়। মন্দিরের সামনে বলির জন্য সব সময় একটি হাঁড়িকাঠ থাকে। সন্ধিপুজোর আগে তারই পাশাপাশি আরও তিনটি হাঁড়িকাঠ রাখা হয়। খড়্গ হাতে চার জনই প্রস্তুত, তারা অপেক্ষা করছেন পুরোহিতের ঘন্টা বাজানোর জন্য। পুরোহিত নির্দিষ্ট নির্ঘন্ট মেনে ঘন্টা বাজালেন। সঙ্গে সঙ্গে চারটে খড়্গ এক সঙ্গে পড়ল চারটি পাঁঠার ঘাড়ে! অষ্টমীতে কিন্তু ওই চারটি ছাড়া আর অন্য কোনও বলি হয় না। নবমীর দিনেও বলি হয়। যত মানুষ মানত করেন, তাঁদের মানসিকের ছাগ বলি হয় নবমীতে। এক টানা আনন্দ শেষে দশমীতে বিসর্জন। পরিবারের সকলে মাথায় ঘট নিয়ে মায়ের ঘট পুকুরে বিসর্জন দিতে যান বাদ্যি বাজিয়ে। তবে বাজনার সুরে সে দিন আনন্দ থাকে না, থাকে বিষাদের সুর।
ভোগ বিশেষত্ব

পুজোর ক’দিন নৈবেদ্যর থালায় ভরে ওঠে মণ্ডপ। নৈবেদ্য হয় আতপ চালের। গাওয়া ঘিয়ে ভাজা লুচি, নারকেল নাড়ু আর মিষ্টিও থাকে। মায়ের ভোগে খিচুড়ি, তরকারি, পায়েস সপ্তমী থেকে নবমীর দিন পর্যন্ত দেওয়া হয়।

Durga Puja of Hooghly

হুগলি

আরামবাগ খামারবেড় গ্রামের দুর্গাপুজো - দেবাশিষ বন্দ্যোপাধ্যায়







দেবীপক্ষ থেকে রামায়ণ গান দিয়ে দুর্গাপুজোর শুরু। আরামবাগের খামারবেড় গ্রামের ১৩ ঘর ভট্টাচার্য পরিবারের এই পুজো ১৩-১৪টি গ্রামের আকর্ষণ। দশমী পর্যন্ত দেবীর আটচালায় রামায়ণ গান চলে। ব্যতিক্রম হলেই ক্ষমা নেই। শরিকদের কারও কিংবা গায়কের মুখ দিয়ে রক্ত উঠবে। পূজায় মন্ত্র উচ্চারণ বা পূজা সংক্রান্ত আচার-আচরণে ত্রুটি থাকলে সঙ্গে সঙ্গে মুখ দিয়ে রক্ত ওঠা, অসুস্থ হয়ে যাওয়ার হাজার রোমহর্ষক কাহিনি ছড়িয়ে আছে খামারবেড়ের এই পুজোকে কেন্দ্র করে।

পুজোর শুরু

এলাকায় ‘জাগ্রত’ বলে বিশেষ খ্যাত এই দুর্গাপুজোর বয়স ৫০০ বছর বলে দাবি করেছেন ভট্টাচার্য পরিবারের বয়স্করা। শ্রদ্ধা-ভক্তি এবং আতঙ্কের মিশেলে পারিবারিক প্রাচীন পুজোটি ক্রমশই সর্বজনীন পুজোর রূপ নিয়েছে।

পুজোর বৈশিষ্ট্য

সন্ধিপুজোর সময় বহু দূর দূরান্ত গ্রাম জয়রামপুর, বলরামপুর, বলুণ্ডি, কাষ্ঠদহি ইত্যাদি থেকে পুজো দেখতে আসেন মানুষ। অষ্টমী এবং নবমীর দিন পুজোপ্রাঙ্গণে কয়েক হাজার ভক্তের মধ্যে হতাশাগ্রস্ত এবং অসুস্থ মানুষের লাইন পরে যায় মায়ের পুজোর প্রসাদী ফুল সংগ্রের জন্য। সন্ধিপুজোয় দুর্গা - কালি হিসাবে পূজিত হন বলেই দুর্গার চার হাত, জানালেন ভট্টাচার্যরা। দুর্গার চারহাতে থাকে ত্রিশূল, চক্র, খড়্গ এবং সাপ।

ভোগ বিশেষত্ব

মহাষ্টমীর দিন মায়ের প্রসাদ হিসেবে ‘ভাত ভোগ’ হয়। রামায়ণ গায়ক প্রতিবছর একাদশী তিথিতে ‘রামরাজা’ গান শেষ করে মায়ের কাছে প্রতিজ্ঞা করবেন ‘আসর ছেড়ে, মাগো যদি আমি অন্য আসরে গান গাই, মোর মাথা খাও তোমায় শিবের দোহাই’। এর পর দোহাই দিতে হয় মূর্তি শিল্পী এবং ঢাকিকেও। পূজারি ভট্টাচার্যরা নিজেরাই অন্যের অপরাধের আশঙ্কায় ১৩ ঘর ভট্টাচার্যর আবালবৃদ্ধবনিতা সকাল-সন্ধ্যা দু’বেলা প্রতিপদ থেকে ১০ দিন নাকখত দেবেন দেবীর আটচালায়।

সপ্তমী, অষ্টমী এবং নবমী তিন দিনই পাঁঠা বলি হয়। পাঁঠা যোগাড়ে, কলা পাতা, বেল পাতা যোগাড়ে পর্যন্ত বংশানুক্রমে চলে এই পুজোয়। অন্য কোথাও উপার্জনের বেশি সম্ভাবনা থাকলেও দেবীর কোপে পড়ার আতঙ্কে রামায়ণ গায়ক থেকে শুরু করে বেলপাতা যোগাড়ে পুজোর দিনগুলো খামারবেড়ের জন্য ফাঁকা রাখেন। দশমীর দিন প্রতিমা বিসর্জন হয় গ্রামের পুকুরে ‘দুর্গার ঘাট’-এ। পুকুরের এই ঘাট সারাবছর সংরক্ষিত রাখা হয়। ঘাট সরানো নিষেধ। বিসর্জন পর্ব শুরু হয় কলা বৌ-এর বিসর্জন দিয়ে। বিসর্জন পর্ব শেষ হলে মহিলাদের কান্নাকাটি করার রীতি আছে।

Durga Puja of Hooghly

হুগলি

আরামবাগ ময়াল গ্রামের ‘জলকর’ রায় পরিবারের দুর্গাপুজো - দেবাশিষ বন্দ্যোপাধ্যায়








পুজোর শুরু

সদগোপ প্রধান ময়াল গ্রামের রায় পরিবারের পূর্বপুরুষরা, দ্বারকেশ্বর নদ থেকে শুরু করে তমলুক পর্যন্ত বিভিন্ন নদনদী থেকে জলকর আদায়ের কাজে নিযুক্ত ছিলেন। এবং এই জলকরের আয় থেকেই পুজোর সূচনা হয়েছিল বলে জানান গ্রামের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক মোহনলাল রায়। সেই আমলের এই নবাবী আদেশনামার জন্যই নাম হয় ‘জলকর রায়’। জ্ঞাতিভাইয়ের এই শরিকি পুজোর খরচের প্রায় ৫০ হাজার টাকা আসে দেবত্র জমিজমা এবং দু’টি পুকুরের মাছ চাষ থেকে।

পুজোর বৈশিষ্ট্য

এই দুর্গা প্রতিমার হাত দু’টি, মহিষাসুর নেই। ডাকের সাজে সজ্জিত। চালচিত্রের উপর বিভিন্ন দেবদেবীর চিত্র আঁকা। রীতি হল প্রতিমার মূর্তির মুখের আদল একই রকম হবে। পুরুষানুক্রমে কুমোররা মূর্তি গড়েন এখানে। ‘জলকর’ রায়বাড়ির দুর্গাপুজো শুরু হয় জিতাষ্টমীর পরের দিন। প্রায় ৩০০ বছরের প্রাচীন পুজোটি এই নিয়মেই হয়ে আসছে বরাবর। পুজোর আড়ম্বর শুরু হয় প্রতিপদ থেকেই। এ দিন পরিবারের কুলপুরোহিত অষ্টধাতুর ভুবনেশ্বরী মাতার মূর্তি মূলমন্দির থেকে এনে দুর্গাদালানে স্থাপন করেন। লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক ও গণেশের মূর্তি অবশ্য মাটির। পারিবারিক এই পুজোয় কুমড়ো বলির সঙ্গে ছাগ বলি প্রথা আছে। সম্প্রতি ছাগ বলির নির্মম প্রথাটি বন্ধের জন্য স্থানীয় কিছু মানুষজন চেষ্টা চালাচ্ছেন। পুজোর ক’টা দিন নাড়ু, মুড়কি, ফল, মিঠাই বিতরণ পুজোটিকে মহোৎসবে পরিণত করে। তিনশো বছরের এই পুজোর একটিমাত্র রীতি পালন করা যাচ্ছে না বলে আক্ষেপ জলকর রায় পরিবারের। প্রথা ছিল প্রতিমা বিসর্জনের পর শঙ্খচিল দর্শন করে ঠাকুরদালানে ফিরতে হবে। কিন্তু গ্রামে এখন শঙ্খচিল বিলুপ্ত। অগত্যা ‘শঙ্খচিলের স্মরণ’ নিয়ে নদী ঘাট থেকে ফিরে আসতে হয়। বিসর্জনের পর রায়পরিবারের প্রত্যেককে বিল্বপত্রে লাল কালি দিয়ে দুর্গা নাম লিখতে হয়। তার পর শান্তিজল নেওয়ার পর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান দিয়ে উৎসব শেষ হয়।

Durga Puja of Mushidabad

মুর্শিদাবাদ

নতুনবাজার সেনবাড়ির দুর্গাপুজো - দেবাশিষ বন্দ্যোপাধ্যায়

অবিভক্ত বাংলার সাবজজ্ রাধাকৃষ্ণ সেন বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজের প্রথম এফ.এ। তাঁর বাল্যবিধবা কন্যা বিন্দুবাসিনী মাতৃ আরাধনার আর্জি করলেন। কন্যার আবদার মেনে নিলেন তিনি। ১১৫ বছর আগে সেনবাড়ির এই মন্দিরে দেবী চণ্ডীর বদলে পূজিত হতেন দেবী জগদ্ধাত্রী। রাধাকৃষ্ণ সেনের বর্তমান প্রজন্ম সুবীর সেন বলেন, “সেই থেকে সেনবাড়ির জগদ্ধাত্রী রূপান্তরিত হলেন দেবীদুর্গায়। আসলে যিনি জগদ্ধাত্রী তিনিই তো দেবীদুর্গা।”







পুজোর শুরু

নতুনবাজার এলাকার ৩ নম্বর গিরিজা চক্রবর্তী লেনের সেনবাড়ির দেবীদুর্গার আরাধনা শুরু হয় ১৮৯৬ সালে।

পুজোর বৈশিষ্ট্য

সেনবাড়ির দেবীদুর্গা কিন্তু তাঁর চতুর্থ হাত দিয়ে অসুর বধ করেন।

বাড়ির মন্দিরের বেদীতেই রথের দিন কাঠামো পুজো হয়। ভাদ্র মাসে ঠাকুর তৈরির কাজ পুরোপুরি বন্ধ থাকে। অসুর হয় সবুজ রঙের। আসলে মহিষাসুরের বদলে প্রতীকস্বরূপ দেবীর পায়ের কাছে মহিষের ছোট্ট একটি মাথা থাকে। একচালার সাবেকি প্রতিমার পুজো হয় বৈষ্ণব মতে। তবে ষষ্ঠী ও সপ্তমীতে গঙ্গায় ঘট ভরতে যাওয়ার সময় বাড়ির কোনও সধবাকে কাঁখে ঘটি নিয়ে বাড়ির মূল দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। পুরোহিত ওই মহিলার সামনে দিয়ে ঘট ভরতে যান গঙ্গায়। সাত রকমের গোটা ফল, বেলপাতা ও শোলার কদমফুল দিয়ে তৈরি করা হয় পুজোর ‘রচনা’। সন্ধিপুজোর শুরু ও শেষের সময় গুলি ছোঁড়ার রেওয়াজ ছিল। বরাবরের এই রেওয়াজ বন্ধ হয়ে গিয়েছে প্রায় কুড়ি বছর আগে।

ভোগ বিশেষত্ব

ভোগেরও বিশেষত্ব রয়েছে সেনবাড়ির পুজোয়। ভোগের মেনুতে ৫৫টি লুচির সঙ্গে থাকবে পাঁচ রকমের তরকারি, শাক, আলু ও পটল ভাজা। নবমীর ভোগে কাঁচকলা ভাজা, কাঁচকলার টক ও বাড়িতে তৈরি নারকেল নাড়ু ‘মাস্ট’। এ ছাড়া প্রতিদিন ছানা, দই ও মিছরি তো থাকেই। দেওয়া হয় আতপ চালের নৈবেদ্য । তবে সপ্তমী, অষ্টমী ও নবমী পুজোয় আতপ চালের ১৭টি নৈবেদ্য দেওয়া হলেও সন্ধিপুজোয় আতপ চালের ১৯টি নৈবেদ্যের প্রয়োজন।

Durga Puja of Mushidabad

মুর্শিদাবাদ

ডোমকলের পালবাড়ির অকালবোধন - দেবাশিষ বন্দ্যোপাধ্যায়








জমিদার বাড়ির পুজো বলে কথা। ১০৮ ঢাকে কাঠি পড়লেই এলাকার পাঁচটা গাঁয়ের মানুষ বুঝে যেত পাল বাবুদের বাড়িতে মায়ের আবির্ভাব ঘটেছে। গ্রামবাসীদের কথায় জমিদারি না থাকলেও পাল পরিবারের কর্তারা এখনও আছেন গ্রামে। নেই কেবল ১০৮ ঢাকি আর তার মন কাড়া বোল।

পুজোর শুরু

অবিভক্ত ভারতের ময়মনসিংহের আনন্দমোহন কলেজের অধ্যাপক ছিলেন পরিবারের কর্তা শরৎচন্দ্র পাল। ডোমকলের বাজিতপুর গ্রামে তিনিই ১০৮ বছর আগে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন পারিবারিক পুজোর। পরিবারের ছোট ছেলে গোপালকৃষ্ণ পাল বলেন, “এ বার আমাদের পুজো ১০৮ বছরে পা রাখল। এ বছরটাই ১০৮ ঢাকির কথা বার বার মনে পড়ছে। ওরা মিছিল করে নাচতে নাচতে আসত ক’টা দিন মহানন্দে কাটিয়ে ঘরে ফিরত। ওদের মধ্যে এত ভাল ঢাকি ছিল যে তাদের ঢাকের শব্দ শুনলেই মানুষ বলে দিত অমুক ঢাকি এসেছে।”

পুজোর বৈশিষ্ট্য

১০৮ জন ঢাকির সম্মিলন এই পুজোর অন্যতম বৈশিষ্ট্য। অধ্যাপক শরৎবাবু ছিলেন সংস্কারমনা। তিনি নারী এবং দলিত শ্রেণিকে গুরুত্ব দিতেন। তার লক্ষ্য ছিল অসংগঠিত ঢাকিদের সংগঠিত করা। পুজোর ক’টা দিনে আনন্দটা যেন তারাও গায়ে মাখতে পারে সে দিকে লক্ষ রেখে ১০৮ ঢাকির ব্যবস্থা। এই পুজোতে দেবী দুর্গার সঙ্গে দেখা মেলে রাম-লক্ষ্মণ-বিভীষণ-হনুমান ও জাম্বুবানের। প্রতিষ্ঠা বর্ষে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে একাদশীতে বিসর্জন হয়েছিল এই পুজোর। আর তার পর থেকে সেটাই নিয়মে পরিণত হয়েছে। প্রতি বছর একাদশীতেই বিসর্জন হয় প্রতিমার।

ভোগ বিশেষত্ব

পুজোতে অন্নভোগ হয় না। লুচি, তরকারি, মণ্ডা, নাড়ু এ সবই প্রসাদ।

Durga Puja of Mushidabad

মুর্শিদাবাদ

কাশিমবাজার ছোট রাজবাড়ির দুর্গাপুজো - দেবাশিষ বন্দ্যোপাধ্যায়








আঠারো শতকে এই রাজ পরিবার প্রতিষ্ঠা করেন অযোধ্যানাথ রায়। প্রায় দেড় দশক ধরে পুজোর ও রাজবাড়ির প্রাচীন জৌলুস ফেরানোর ব্যাপারে মনোনিবেশ করেছেন রাজবাড়ির বর্তমান বংশধর প্রশান্ত রায় ও তাঁর সহধর্মিনী সুপ্রিয়াদেবী। সুপ্রিয়াদেবী অবশ্য ‘রানিমা’ নামেই বেশি পরিচিত। মূলত তাঁর প্রচেষ্টাতে অতীতের গন্ধ আজ অনেকখানিই ফিরে এসেছে কাশিমবাজারের ছোট রাজবাড়ির পুজোয়।

পুজোর শুরু

রাজবাড়ির এই দুর্গাপুজো প্রায় ৩০০ বছরের প্রাচীন। অযোধ্যানাথ রায়-এর পৌত্র জগদ্বন্ধু রায় ছিলেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দেওয়ান। তাঁর আমল থেকে কাশিমবাজার ছোট রাজবাড়ির শ্রীবৃদ্ধির ও দুর্গাপুজোর শুরু।

পুজোর বৈশিষ্ট্য

রথের দিন কাঠামো পুজো আবশ্যিক। একচালার সপরিবার সাবেক দেবীমূর্তি। রাজবাড়ির মন্দিরে শুক্লা প্রতিপদ থেকে পঞ্চমী পর্যন্ত ৩ জন পুরোহিত চণ্ডীপাঠ করেন। ৩ জন পুরোহিত দুর্গানাম জপ করেন। আর প্রধান পুরোহিত বিল্ববৃক্ষের শাখার পুজোপাঠ করেন। ষষ্ঠীর সন্ধ্যায় দুর্গার বোধন, আমন্ত্রণ ও অধিবাস সম্পূর্ণ হয়। সপ্তমীতে ঘট ভর্তি করে মূর্তির প্রাণ প্রতিষ্ঠা করা হয়। রাজ পুরোহিত গোপাল রায় বলেন,‘‘সপ্তমী, অষ্টমী ও নবমীতে কুমারীপুজো ও সধবা পুজো হয়।”

তন্ত্র মতের এই পুজোয় আগে বলিদান প্রথা ছিল। পুরোহিত বলেন, ‘‘প্রায় ৩৭ বছর আগে রাজা কমলারঞ্জন রায়ের আমলে ঘাতকের অভাবে বলিদান প্রথা বাতিল করা হয়। সেই থেকে বলির অনুকল্প হিসাবে দেবীকে রুই মাছের ঝোল ও কাঁচা সন্দেশ নিবেদন করা হয়।”

তুলট কাগজে হাতে লেখা ৪৫ পাতার নিজস্ব পুঁথি থেকে মন্ত্র পড়ে পুজো হয়। নবমীতে পঙক্তি ভোজন ও প্রসাদ বিতরণ করা হয়। দশমীতে মহিলাদের সিঁদুর খেলা ও অপরাজিতা পুজো হয়। দশমীতে প্রতিমা নিরঞ্জনের পর রাজবাড়ির সদস্যরা নাটমন্দিরে সমবেত হন। সেখানে তাঁদের আর্শীবাদ করেন রাজ পুরোহিত।

ভোগ বিশেষত্ব

সপ্তমী, অষ্টমী ও নবমী— তিন দিনই থাকে অন্নভোগের আয়োজন। সাদা ভাতের সঙ্গে থাকে ফ্রায়েড রাইসও। ডাল-ভাতের সঙ্গে থাকে আলু, পটল, বেগুন, কুমড়ো ও বড়া মিলিয়ে পাঁচ রকমের ভাজা, আলু-কপি, অথবা আলু-পটলের দোর্মা, পাঁচ তরকারি, রুই মাছের ঝোল, শাক, চাটনি, মিষ্টি ও পায়েস। নবমীর দিন ভোগের মেনুর সঙ্গে যুক্ত হয় মোচার ঘণ্ট, লাউ-চিংড়ি ও ইলিশ মাছের ঝোল, ভাপা ও ভাজা। সন্ধিপুজোয় থাকে খিচুড়ি, আলু, বেগুন, পটল ভাজা ও মাছ ভাজা।

Durga Puja of Purulia

পুরুলিয়া

সিমলাপাল রাজবাড়ির দুর্গাপুজো - দেবাশিষ বন্দ্যোপাধ্যায়








পুজোর শুরু

প্রায় ৪০০ বছরের পুরনো পুজো। কে শুরু করেছিলেন, তা জানা যায়নি। তবে শেষ রাজা ছিলেন শ্যামসুন্দর সিংহ চৌধুরি। পুজো তাঁর সময়ের অনেক আগে থেকেই চলছে।

পুজোর বৈশিষ্ট্য

আগে পুজোয় শতাধিক ছাগশিশু বলি হত। ১৯৯৫ সাল থেকে পশু বলি পুরোপুরি বন্ধ। রাজ পরিবারের বর্তমান বংশধরেরা পশু বলির ঘোর বিরোধী। তবে পশু বলি ছাড়া পুজোর অন্যান্য নিয়ম নিষ্ঠা এখনও মেনে চলা হয়। অষ্টমীর সন্ধিপুজোর আখ বলির ধরণ একটু ভিন্ন। দেবীর থানে ত্রিভুজের আকারে আখগুলি দাঁড় করানো হয়। এর পর বলি দেওয়া হয়।

ভোগ বিশেষত্ব

বিজয়া দশমীর দিন খিচুড়ি ভোগ এলাকার সব ধর্ম ও সম্প্রদায়ের মানুষজনকে খাওয়ানো হয়।

Durga Puja of Purulia

পুরুলিয়া

হদলনারায়ণপুর গ্রামের মণ্ডল পরিবারের দুর্গাপুজো - দেবাশিষ বন্দ্যোপাধ্যায়














পুজোর শুরু

১৭১২ খ্রীস্টাব্দে বর্ধমানের নীলপুর গ্রাম থেকে এসে হদলনারায়ণপুরে বিষ্ণুপুরের মল্লরাজা গোপাল সিংহ’র পৃষ্ঠপোষকতায় জমিদারির পত্তন করেন মুচিরাম ঘোষ। পারুল পরগনার হদলনারায়ণপুর-সহ কয়েকটি গ্রামের ফৌজদার নিযুক্ত করা হয় তাঁকে। পরে মল্লরাজারা প্রচুর নিষ্কর জমি দিয়ে মুচিরামকে ‘মণ্ডল’ উপাধিতে ভূষিত করেন। তৈরি হয় গোল দরজা, সাত মহলা অট্টালিকা, অপূর্ব স্থাপত্যের রাস মন্দির, রথ, অভিজাত দুর্গা মণ্ডপ।

পুজোর সূচনাও ওই সময়ে। শুধু দুর্গাপুজোই নয়। রাস, রথ ও কালীপুজো পরিচালনার জন্য গঠিত হয়েছে মণ্ডল দেবত্র এস্টেট।

পুজোর বৈশিষ্ট্য

এস্টেটের অন্যতম পরিচালক ধীরাজ মণ্ডল জানান, পুরনো প্রথা মেনে বৈষ্ণব মতে পুজো হয়। পুজোর তিন দিন নিরামিষ খাওয়া হয়। দশমীতে মাছ বলির পর আমিষ গ্রহণ। এই পুজোর অন্যতম বৈশিষ্ট্য, গ্রামের পাশে দামোদরের শাখা নদী বোদাই থেকে পাল্কিতে আসে নবপত্রিকা। বিসর্জনের পরে সিঁদুর খেলায় মাতেন মেয়েরা।

ভোগ বিশেষত্ব

পরিবারের বর্ষীয়ান সদস্য দেবীদাস মণ্ডল জানান, সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয় হল পুজোর চার দিন পরিবারের সকল সদস্যের একাসনে পাত পেড়ে খাওয়া। সেই খাদ্য তালিকায় থাকে ভাতের সঙ্গে মুগের ডাল, আলু ভাজা, শুক্তো, আলু-পটল-পোস্ত, ফুলকপির তরকারি, এঁচোড়, কুমড়োর ছক্কা থেকে পোলাও, ডালপুরী। এ ছাড়াও আনারসের চাটনি, নানা মিষ্টি ও আইসক্রিম।

Durga Puja of Purulia

পুরুলিয়া

কাশীপুর রাজবাড়ির দুর্গাপুজো - দেবাশিষ বন্দ্যোপাধ্যায়








পঞ্চকোট রাজবংশের রাজা কল্যাণশেখরের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল বল্লাল সেনের পালিতা কন্যা সাধনার। বাপের বাড়িতে সাধনার দৈনন্দিন কাজের মধ্যে ছিল কুলদেবী শ্যামারূপার সেবা করা। বিয়ের পরে তাই তিনি বায়না ধরেন শ্যামারূপা দেবীকে সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার। বল্লাল সেন তাতে অনুমতি দিলেন। আর সঙ্গে দিলেন একটি কালো রঙের ঘোড়া।

পথে ক্লান্ত নবদম্পতি একটু বিশ্রামের আশায় দেবীকে একটি গুহার মধ্যে থেকে রেখে ঘুমিয়ে পড়েন। বিশ্রামের পর যাত্রা শুরু করতে গিয়ে হল বিপদ। অনেক চেষ্টা করেও দেবীমূর্তি নড়ানো গেল না। সাধনা ঠিক করলেন নিজের প্রাণ বিসর্জন দেবেন। সহধর্মিণীর কথা শুনে কল্যাণশেখরও আত্মাহুতি দেবেন বলে ঠিক করলেন।

পঞ্চকোটরাজ বংশের বর্তমান প্রজন্মের সোমেশ্বরলাল সিংহ দেওয়ের কথায়, সেই সময়েই দেবী তাঁদের দেখা দেন। কেউ আবার বলেন যখন ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন তখন স্বপ্নে দেবী তাঁদের দেখা দেন। দেবী নির্দেশ দেন, ‘‘আমি এখানেই (মোচলপুর) থাকব। নাম হবে কল্যাণেশ্বরী। আর শ্বশুরবাড়িতে ফিরে গিয়ে তুই আমার চর্তুভুজা মূর্তি প্রতিষ্ঠা করিস। ওখানে আমার নাম হবে রাজরাজেশ্বরী।’’

অষ্টধাতু দিয়ে কোন শিল্পী মূর্তি নির্মাণ করবেন তাও দেবী জানিয়ে দেন সাধনাকে। সেই সঙ্গে বলেন, ‘‘আমি ওখানে তোর পুজো নিতে যাব। মহাষ্টমীর দিন সন্ধিপুজোর সময় আমার পদচিহ্ন দেখতে পাবি।’’ তার পর দেবীকে রেখে তাঁরা দু’জনেই পঞ্চকোটে ফিরে আসেন।

শ্বশুরবাড়িতে ফিরে দেবী নির্দেশিত শিল্পীকে দিয়েই মায়ের চর্তুভুজা মূর্তি নির্মাণ করান কল্যাণশেখর। তার পর থেকে পুজোর সময় সন্ধিপুজোয় মায়ের পায়ের ছাপ পড়ত সোনার থালায় সিঁদুরের উপর। সোমেশ্বর বাবু বলেন, “তার থেকেই প্রবাদ ‘শিখরে পা’। তাই এখানে দেবীর আরেক নাম শিখরবাসিনী।

পুজোর শুরু

বাংলায় যখন সেন বংশের রাজত্বকাল, পুজোর শুরু সেই সময় কালে। হিন্দুধর্মের উপাসক এই রাজবংশে তার আগেও পুজো হত। কিন্তু তা অনেকটা নিজেদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। পঞ্চকোটের রাজা কল্যাণশেখর সিংহ দেও-র মাধ্যমেই পুজোর মাহাত্ম্য ছড়িয়ে পড়ে এলাকায়।

পুজোর বৈশিষ্ট্য

প্রথা মেনে কাশীপুরের দেবীবাড়িতে আজও পুজো হয়। এখানে পুজো শুরু হয় জিতাষ্টমীর পরের দিন থেকে। টানা ১৪ দিন ধরে চলে পুজো।

ভোগ বিশেষত্ব

১৪ দিন ধরেই চলে অন্নভোগের আয়োজন।

Durga Puja of Burdwan

বর্ধমান

নতুনগঞ্জের দাসবাড়ির দুর্গাপুজো - দেবাশিষ বন্দ্যোপাধ্যায়








দাস পরিবারের পূর্বপুরুষেরা দেশভাগের পরে প্রথমে নবদ্বীপ, পরে বর্ধমানে আসেন। তাঁরা একদা ছিলেন বাংলাদেশের খুলনার তালতলা গ্রামের বাসিন্দা। সেখানে কুঞ্জবিহারী দাসের আমলে শুধু সিংহবাহিনীর পুজো চলত।

পুজোর শুরু

রাধাবল্লভ জীউ মন্দিরের কাছে নতুনগঞ্জে দাসবাড়ির পুজো এবার ৫০তম বর্ষে পদার্পণ করেছে। কৃষ্ণভক্ত হরিচরণ দাস-এর সময় থেকেই এই পুজোর শুরু। পুজো হত বর্ধমানের দিঘিরপুলের ভাড়াবাড়িতে।

পুজোর বৈশিষ্ট্য

বর্ধমানের নতুনগঞ্জ বা দিঘিরপুলের বাড়িতে একক মূর্তির সঙ্গে যোগ হয় কার্তিক, গণেশ, লক্ষ্মী ও সরস্বতী। ডাকের সাজের সাবেকি একচালা মূর্তি। পুজোয় বলিদান নিষিদ্ধ। পুজো হয় বৈষ্ণব মতে।পারিবারিক এই পুজোয় প্রায় প্রতিদিনই কয়েকশো লোককে খাওয়ানোর রেওয়াজ আছে। সেই সঙ্গে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানেরও ব্যবস্থা করা হয়।

Durga Puja of Burdwan

বর্ধমান

ইদিলপুর ঘোষবাড়ির দুর্গাপুজো - দেবাশিষ বন্দ্যোপাধ্যায়








পশ্চিম বর্ধমানের ইদিলপুরে ঘোষবাড়ির পুজোমণ্ডপ দামোদর সংলগ্ন নদীবাঁধের গায়ে।

পুজোর শুরু

পশ্চিম বর্ধমানের ইদিলপুরে ঘোষবাড়ির পুজো প্রায় ২০০ বছরের পুরনো।

পুজোর বৈশিষ্ট্য

পাকা আটচালায় হয় পুজো। নদী থেকে পরিবারের মহিলাদের লালপাড় শাড়িতে দল বেঁধে ঘটোত্তোলন আর চণ্ডীপাঠ দেখতে দলে দলে স্থানীয় মানুষ ভিড় করেন দামোদরের গায়ে। পুজোর দিনগুলিতে আগে যাত্রা, থিয়েটারের আসর বসত। পর্দা টাঙিয়ে চলতো জনপ্রিয় বাংলা চলচ্চিত্রের প্রদর্শনী। নবমীতে হত মোষ বলি। এই প্রথা আজও রয়েছে। এখন বলির মহিষ অমিলের কারণে পুজোর অনেক আগে থেকে মহিষ সংগ্রহ করে সেটাকে লালন-পালন করা হয়। পরিবারের সদস্যদের অনেকেই চাইছেন এই অমানবিক প্রথা তুলে দিতে। কিন্তু পুরোহিতেরা এখনও বলি বন্ধের ‘বিধান’ দেননি।

Durga Puja of Burdwan

বর্ধমান

বোরহাটের দেবেন্দ্রভবনের পটেশ্বরী দুর্গা পুজো - দেবাশিষ বন্দ্যোপাধ্যায়








বর্ধমানের বোরহাটের দেবেন্দ্রভবনের পটেশ্বরী দুর্গার পুজোর এ বার শতবর্ষ।

পুজোর শুরু

১৯১১ সালে পটেশ্বরীর পুজোর প্রচলন বর্ধমানের কাঞ্চননগরে। বেশ কয়েক বছর আগে অষ্টমীর দিন এই পরিবারের দুই ভাই দেবেন্দ্র ও রাজেন্দ্রলালের মধ্যে শরিকি সংঘর্ষ হয়। ফলে সেই বছর মৃন্ময়ীদেবীর পুজো হয়েছিল রাজেন্দ্রলালের বাড়িতে। ছোটভাই দেবেন্দ্রলাল-র পরিবারের সদস্যেরা পুজোর ডালা নিয়ে গেলে, তাঁদের অপমান করে তাড়িয়ে দেন রাজেন্দ্রলালের বাড়ির লোকেরা। সেই ঘটনায় ক্ষুব্ধ হয়ে দেবেন্দ্র দুর্গার ছবি নিয়ে পুজো শুরু করেন। পরের বছর থেকে দেবেন্দ্রলালের ভবনে পটেশ্বরীর আগমন।

পুজোর বৈশিষ্ট্য

পটে লেখা দেবীর আকার প্রায় মৃন্ময়ী মূর্তির মতোই। ষষ্ঠীর বদলে সপ্তমীতে শুরু হয় বোধন। শরিকি সংঘর্ষের কথা স্মরণ করতেই এই নিয়ম। একদা কাটোয়া থেকে শিল্পীরা পট এঁকে আনতেন। কিন্তু এখন তা আঁকেন স্থানীয় শিল্পী। দশমীর দিন কৃষ্ণসায়রের চাঁদনী ঘাটে ঘষে ঘষে তুলে ফেলা হয় দেবীর রং। এটাই বিসর্জনের প্রথা।

পশুবলি বা কোনওরকম বলিপ্রথায় বিশ্বাসী নয় এই পরিবার।

Durga Puja of Kolkata

কলকাতা

গড়িয়ার বন্দ্যোপাধ্যায় বাড়ির পুজো - দেবাশিষ বন্দ্যোপাধ্যায়








দক্ষিণ গড়িয়ার বন্দ্যোপাধ্যায় বাড়ির পুজো বেশ প্রাচীন। দক্ষিণ ২৪ পরগনার সুভাষগ্রাম স্টেশন থেকে অটোরিকশায় দক্ষিণ গড়িয়ার যদুনাথ বিদ্যামন্দিরের কাছেই বন্দ্যোপাধ্যায় বাড়ির দুর্গাদালান।

পুজোর শুরু

এই পরিবারের যদুনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় এই পুজোর সূচনা করেন বলে জানা যায়। যথাযথ সাক্ষ্য প্রমাণ না থাকলেও পরিবারের সদস্যের দাবি এটি প্রায় ৩২৫ বছরের পুরনো পুজো।

পুজোর বৈশিষ্ট্য

জন্মাষ্টমীর পরের দিন নন্দোৎসব। সে দিন হয় কাঠামো পুজো। ওই দিন গরানকাঠের টুকরোকে কাঠামো হিসেবে পুজো করা হয়। দেবীপক্ষের পঞ্চমীর দিন বোধন বসে। একচালা, বাংলা রীতির মহিষাসুরমর্দিনী, ডাকের সাজের প্রতিমা। সিংহ ও ময়ূর ব্যতীত অন্য দেবতাদের বাহন থাকে না। নবমীতে আখ, ছাঁচিকুমড়ো ও কলা বলি হয়। দশমীর দিন এখনও প্রতিমা কাঁধে করে বয়ে নিয়ে গিয়ে পারিবারিক পুকুরে বিসর্জন দেওয়া হয়।

Durga Puja of Kolkata

কলকাতা

ভবানীপুরের মুখোপাধ্যায় পরিবারের পুজো - দেবাশিষ বন্দ্যোপাধ্যায়







পরিবার সূত্রে জানা যায়, হরচন্দ্র মুখোপাধ্যায় পৌরোহিত্যের পেশা নিয়ে দক্ষিণ ২৪ পরগনার ধামুয়া থেকে কলকাতায় এসেছিলেন ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে। তিনি ভবানীপুরের চক্রবেড়িয়া অঞ্চলে ঠাকুরদালান-সহ ভদ্রাসন নির্মাণ করে দুর্গাপুজো আরম্ভ করেন। বাড়ির বর্তমান ঠিকানা ৩৯ গিরীশ মুখার্জি রোড। পুত্র গিরীশচন্দ্র ছিলেন সে যুগের নামকরা উকিল। তাঁর আমল থেকে পুজোর জৌলুস বৃদ্ধি পায়।

পুজোর শুরু

‘গিরীশ ভবন’-এর মুখোপাধ্যায় পরিবারের দুর্গাপুজোর সূচনা ১৮৪২ খ্রিস্টাব্দে।

পুজোর বৈশিষ্ট্য

প্রতিমা সাবেকি একচালা রীতির মহিষাসুরমর্দিনী মূর্তি।

মুখোপাধ্যায় পরিবারের পুজোর বৈশিষ্ট্য হল - পরিবারের এয়োস্ত্রীরা নন, দশমীর সকালে প্রতিমা প্রদক্ষিণ করেন পরিবারের পুরুষ সদস্য এবং ব্রাহ্মণেরা। এই প্রথা চলে আসছে একেবারে শুরু থেকে।

এক কালে এখানে পুজোর সময়ে যাত্রা-নাটক অভিনয়ের চল ছিল। প্রতিবেশী উত্তমকুমারও অংশ নিতেন অভিনয়ে।

Durga Puja of Kolkata

কলকাতা

কল্যাণপুরের বন্দ্যোপাধ্যায় বাড়ির পুজো - দেবাশিষ বন্দ্যোপাধ্যায়








জনার্দন উপাধ্যায় নামে দাক্ষিণাত্যের এক বৈদিক ব্রাহ্মণ মহিষাদলে এসে বসতি স্থাপন করেন সপ্তদশ শতকে। পরবর্তীকালে মহিষাদল রাজপরিবারের সঙ্গে এই উপাধ্যায় পরিবারের সখ্য হয় ও তাঁরা বংশানুক্রমে রাজকার্যে যুক্ত হন। সহস্ররাম বন্দ্যোপাধ্যায় নামে তেমনই এক রাজকর্মচারীর কাজে খুশি হয়ে মহিষাদল রাজপরিবারের পক্ষ থেকে বারুইপুরের কল্যাণপুর গ্রামটি বসবাসের জন্য দান করেন। তাঁরই উদ্যোগে এই পরিবারের দুর্গাপুজো আরম্ভ হয়।

পুজোর শুরু

পারিবারিক সূত্র থেকে জানা যায়, বারুইপুর বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবারের পুজো আরম্ভ হয়েছিল ১১৫৭ বঙ্গাব্দে।

পুজোর বৈশিষ্ট্য

মহিষাসুরমর্দিনীর একচালা প্রতিমা। ষষ্ঠীতে বোধন। অষ্টমী-নবমীর সন্ধিক্ষণের সন্ধিপুজোয় এখনও বন্দুক ফাটানো হয়। নবমীতে এখনও পাঁঠাবলি বজায় রেখেছে এই পরিবার। দশমীর দিন বিসর্জনের আগে পর্যন্ত পরিবারে অরন্ধন। সকালে পরিবারের সদস্যরা পান্তা ভাত খান। সন্ধ্যায় বিসর্জন সমাপ্ত হলে রান্না আরম্ভ হয়।

Durga Puja of Bongaon (24 Pgs - North)

উত্তর ২৪ পরগনা: বনগাঁ

বনগাঁর বন্দ্যোপাধ্যায় বাড়ির পুজো - দেবাশিষ বন্দ্যোপাধ্যায়








২০০০ সালে পুজোর আগে বন্যায় গোটা বনগাঁ মহকুমার বিস্তীর্ণ এলাকা ভেসে যায়। ষষ্ঠীর দিন কী ভাবে দেবীর বোধন করা হবে তা নিয়ে চিন্তিত ছিলেন ওই পরিবারের সদস্যরা। কারণ বোধনতলা জলের তলায় চলে গিয়েছিল। বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবারের প্রবীণ সদস্যা শোভাদেবী বলেন, ‘‘কী ভাবে দেবীর বোধন হবে তা নিয়ে আমরা চিন্তিত ছিলাম। শিব মন্দিরের উঁচু ঢিবিতে বোধন করবার পরিকল্পনাও নেওয়া হচ্ছিল। কিন্তু হঠাৎই ষষ্ঠীর আগে বোধনতলায় দু’তিন হাত জল কমে যায়। নির্দিষ্ট স্থানেই বোধন করতে পেরেছিলাম আমরা।’’

বন্যার মধ্যে ১৩০ জন এই বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। তাদেরকে নিয়েই সে বার জমে উঠেছিল পুজো। কিন্তু বিসর্জন দেওয়ার আগে ফের বিপত্তি দেখা দেয়। প্রতিমা কী ভাবে পাশে নাওডাঙা নদীতে নিয়ে যাওয়া হবে তা ভেবে পাচ্ছিলেন না পরিবারের লোকেরা। হঠাৎই এক জেলে বউ সেখানে উপস্থিত হন, মাকে সিঁদুর পরানোর জন্য। তাদের সঙ্গে নৌকাও ছিল। সেই নৌকা করেই প্রতিমা বিসর্জন দিতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।

পুজোর শুরু

৩০০ বছর ছাড়িয়েছে পুজোর বয়স। বনগাঁর ছয়ঘরিয়ার গৌরহরি বন্দ্যোপাধ্যায়কে স্বপ্নে দেখা দিয়ে দেবী বলেছিলেন, তাঁর কোন রূপের পুজো করতে হবে! ঐতিহাসিক রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঠাকুরদাদা, গৌরহরি বন্দ্যোপাধ্যায় এই পুজোর সূচনা করেছিলেন।

পুজোর বৈশিষ্ট্য

দুর্গার দশটি হাত থাকলেও কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে। দু’টি হাত বড়, বাকি আটটি হাত ছোট! দু’পাশের কাঁধে রয়েছে ছোট ছোট চারটি হাত। অনেকটা বিড়ালের হাতের মতো! সে কারণে এই দুর্গাকে বলা হয় ‘বিড়ালহাত দুর্গা’।

মহালয়ার পরের দিন, প্রতিপদে চণ্ডীর ঘট বসানো হয়। পুজোর দিনগুলিতে চলে চণ্ডীপাঠ। ষষ্ঠীতে বাড়িতে থাকা জোড়া শিব মন্দিরের নীচে বেলতলায় হয় দেবীর বোধন।বিসর্জনের আগে বাড়ির পুরুষ সদস্যরা দেবীকে বরণ করেন। তার পর মহিলারা। নিয়ম মেনে দশমীর দিন আকাশে একটি সন্ধ্যাতারা উঠলেই বন্দ্যোপাধ্যায়বাড়ির প্রতিমা নাওডাঙা নদীতে বিসর্জন দিয়ে দেওয়া হয়। বিসর্জন দেখতেও বহু মানুষ ভিড় করে।

ভোগ বিশেষত্ব

অষ্টমীর দিন যাঁরাই ঠাকুর দেখতে যান তাদের সকলকে ভোগ প্রসাদ খাওয়ানো হয়। অতীতে পাঠাবলি দেওয়া হলেও এখন সে সব পাট চুকে গেছে। চিনি ও নাড়ু নৈবেদ্য দেওয়া হয়। অতীতে ছয়ঘরিয়া গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকার বহু গ্রামের মানুষের পুজোর দিনগুলিতে ঠিকানা ছিল এই বন্দ্যোপাধ্যায় বাড়ি। কয়েক হাজার গ্রামবাসীকে খাওয়ানো হত, সেই পরম্পরা অবশ্য এখনও আছে। তবে আয়োজনের ব্যাপকতা কমেছে।

Durga Puja of Basirhat (24 Pgs - North)

উত্তর ২৪ পরগনা: বসিরহাট
ব্রহ্মানন্দ মহারাজের বাড়ির পুজো - দেবাশিষ বন্দ্যোপাধ্যায়











১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দে বসিরহাটের শিকড়ার কুলিন গ্রামে জন্মেছিলেন আনন্দমোহন ঘোষের ছেলে রাখালচন্দ্র।পরবর্তীতে রামকৃষ্ণের মানসপুত্র রাখালচন্দ্রের নাম হয়েছিল ব্রহ্মানন্দ মহারাজ। তিনিই রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের প্রথম প্রেসিডেন্ট মহারাজ। লোকে তাকে রাজা মহারাজ বলেই ডাকতেন। তিনশো বছর পার হয়ে ব্রহ্মানন্দ মহারাজের স্মৃতি বিজড়িত ঘোষ পরিবারের দুর্গাপুজো মহকুমার মধ্যে অন্যতম প্রাচীন পুজো।
পুজোর শুরু
ঘোষ পরিবারের বয়স্করা জানান, পুঁথিপত্র ঘেঁটে যতদূর জানা যায় ১৭০০ খ্রিস্টাব্দে ব্রহ্মানন্দ মহারাজের বাড়ির পুজো শুরু হয়েছিল। দেবী চণ্ডীর পুজোর প্রথম উদ্যোক্তা ছিলেন জমিদার দেবীদাস ঘোষ
পুজোর বৈশিষ্ট্য
ঘোষ বাড়িতে পুজো হয়ে চলেছে পরম্পরা মেনে। কথিত আছে প্রচলিত নিয়ম মানা না হলে নাকি ‘ক্ষতি’ অবশ্যম্ভাবী। কোনও পরিবর্তন করা হলেই আর রক্ষা নেই। পূর্ব পুরুষদের আমল থেকে এমন প্রবাদ মুখে মুখে চলে আসলেও তার সত্যতা প্রমাণ করতে গিয়েই নাকি একবার নবমীর দিনে ঘোষ পরিবারের দুই ছেলের মৃত্যু হয়েছিল। সেই থেকে আর কেউ সাহস করে পরিবর্তনের কথা ভাবেন না।
বংশ পরম্পরায় প্রতিমা তৈরি করেন ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের মানুষেরা। সূচনা পর্বে যে কাঠামোর উপর প্রতিমা নির্মাণ করা হয়েছিল, প্রতিবার সেই একই কাঠামোর উপরে প্রতিমা তৈরি হয়।
পুজোর শুরুতে দেবীর ঘট বসত মাটির আটচালা ঘরে। ওই ঘরেই পুজোর আয়োজন ও দেবীকে প্রতিষ্ঠা করা হত। পরবর্তীতে জমিদার কালীপ্রসাদ ঘোষ পাঁচ খিলানযুক্ত পুজোর দালান তৈরি করেন। ওই দালানেই নিয়ম নিষ্ঠার মধ্যে এখনও পুজো হয়ে আসছে।
দেবীর বোধনের দিন নিদ্রাকলস বসানো হয়। ঘট থাকে দশমী পর্যন্ত। পরিবারের বিশ্বাস পুজোর ক’দিন পুজোদালান পাহারা দেয় নিদ্রাকলস।
আগে এই পুজোয় বলি হত। তবে একবার বলির সময় এক কোপে পাঁঠার গলা না-কাটায়, বলি বন্ধ হয়ে যায়। সেইসঙ্গে পশুবলি প্রথার অবসান হয়।
দেবীর বিসর্জন দেওয়া হয় স্থানীয় একটি পুকুরে। পুজোর দিনগুলিতে মেলা বসে শিকড়া কুলিনগ্রামে।
ভোগ বিশেষত্ব
এই পুজোর ভোগ মূলত খিচুড়ি ও মরশুমি নানা তরকারির পদ। সঙ্গে লুচি-মিষ্টি-নাড়ু আর বিভিন্ন রকমের ফল।

Durga Puja of Basirhat (24 Pgs - North)

উত্তর ২৪ পরগনা: বসিরহাট

বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের শ্বশুরালয়ের পুজো - দেবাশিষ বন্দ্যোপাধ্যায়








কাঁটাতারের বেড়া। বেড়ার ও পারেই বাংলাদেশ। পাশ দিয়ে বয়ে গেছে ইছামতী নদী। গ্রামের একাংশের জীবিকা গামছা তৈরি। এ পারে এল এম জি-বাইনোকুলার হাতে বি এস এফ, ও পারে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ সর্বক্ষণ সজাগ দৃষ্টি রেখে চলেছে। অবৈধ অনুপ্রবেশ ও পাচার রুখতে সীমান্তে রাতকে দিন করতে লাগানো হয়েছে হাজার হাজার ওয়াটের হ্যালোজেন। ওই গ্রামেই পঙক্তি ভোজ খেতে দুর্গাপুজোরর দিনগুলিতে দুই বাংলার মানুষ জাতি ধর্ম ভুলে একত্রিত হয়।

বসিরহাটের এই গ্রামে শ্বশুরবাড়ি ছিল প্রকৃতি প্রেমিক লেখক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের। শ্বশুরবাড়ি হওয়ায় বেশ কয়েকবার পুজোর সময়ে পানিতর গ্রামে এসেছিলেন বিভূতিবাবু। তিনি যে বকুল গাছের তলায় বসে লিখতেন সেই গাছটি আজও বিদ্যমান। স্মৃতি ধরে রাখতে গ্রামবাসীরা চণ্ডীমণ্ডপের সামনে বসিয়েছেন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের আবক্ষ মূর্তি।

পুজোর শুরু

উত্তর ২৪ পরগনার বসিরহাটের পানিতর গ্রামে পুজোর প্রচলন হয়েছিল ১৭৬০ সালে।

পুজোর বৈশিষ্ট্য

জন্মাষ্টমীর দিন কাঠামো পুজো দিয়ে প্রতিমা তৈরির কাজ শুরু হয় নাটমন্দিরে। অতীত-রীতি মেনে এই পুজোর প্রতিমা এখনও তৈরি হয় গঙ্গামাটি দিয়ে।

পুজোর অন্যতম বৈশিষ্ট্য, অষ্টমীর দিনে হিন্দু-মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষের একত্রিত হয়ে এক আসনে বসে ভোজ খাওয়ার রীতি। গ্রামবাসীরা একে ‘ভজরম’ উৎসব বলেন। তাদের দাবি, ভজরম উৎসবের বয়স পুজোর থেকেও প্রাচীন। এক বার ছাড়া কখনও ভজরম উৎসব বন্ধ হয়নি। ২০০০ সালে বন্যার সময় পানিতর গ্রামে সব ভেসে গিয়েছিল নদীর জলে। প্লাবিত হওয়ায় গ্রামের অধিকাংশই ঘর ছাড়া হয়েছিলেন।

ভোগ বিশেষত্ব

মায়ের ভোগে চিরাচরিত ভাবে খিচুড়ি, কয়েকরকমের ভাজা, পঞ্চব্যঞ্জন, পায়েস, চাটনি ও দধি দেওয়া হয়। এ ছাড়া নানা রকম নৈবেদ্যর মধ্যে ফলের পরিমাণই বেশি থাকে। তবে অষ্টমীর দিন ভজরম উত্সবে যে ভোজের আয়োজন করা হয়, তার প্রধান পদ কিন্তু খিচুড়ি।