মেদিনীপুর
পরমানন্দপুরের ঘোষ পরিবারের দুর্গাপুজো - দেবাশিষ বন্দ্যোপাধ্যায়
পুজোর শুরু
১২০৯ সালের ঘটনা। গৃহদেবতা থাকায় আলাদা মণ্ডপ করা যাবে না। আবার বাঙালির সবচেয়ে বড় উৎসব দুর্গা পুজো, তাও করতে হবে। কিন্তু কী ভাবে? পুরোহিতেরা বিধান দিলেন, গৃহদেবতার মন্দিরেই মাটির ‘ঘট’-কে দেবী দুর্গা রূপে পুজো করা হবে। সেই থেকে পুরুষানুক্রমে গৃহদেবতা রঙ্কিনী মাতার মন্দিরে এ ভাবেই দুর্গাপুজো করে আসছেন পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার চন্দ্রকোনা থানা এলাকার পরমানন্দপুর গ্রামের ঘোষ পরিবার। এখনও সেই রীতির কোনও পরিবর্তন ঘটেনি।
পুজোর বৈশিষ্ট্য
যদুনাথ ঘোষের চালু করা এই পুজোর এক একটি দিনের বিশেষত্ব এক এক রকম। ঘোষ বংশের সুশীল ঘোষ, রাজকুমার ঘোষেরা বলেন, “বংশ পরম্পরায় এ ভাবেই পুজো চলে আসছে। পুজোর আচার-আচরণে কোনও পরিবর্তন হয়নি। পুজো হয় পুরনো রীতি মেনেই।”
পুজো শুরু হয় প্রতিপদ অর্থাৎ মহালয়ার পর দিন থেকে। সে দিনই ঘট বসানো হয় মন্দিরে। পুকুর থেকে ঘট মাথায় করে রঙ্কিনী মন্দিরে নিয়ে যান পুরোহিত। তার সঙ্গে থাকে ঢাকের বাদ্যি, শঙ্খধ্বনি, উলুধ্বনি। সেই দিন থেকেই প্রতিদিন চণ্ডীপাঠ হত আগে। বর্তমানে অবশ্য পুজোর ক’দিনই চণ্ডীপাঠ হয়। ষষ্ঠীতে হয় বেলবরণ। পুকুরের ধারেই রয়েছে একটি বেল গাছ। সেই বেলগাছকে দেবী রূপে পুজো করা হয়। সপ্তমীতে কলাবউ স্নান। শিকড়-সহ কলাগাছ তুলে নিয়ে আসা হয়। সুন্দর হলুদ শাড়ি পরানো হয়। কেবল ঘোষ পরিবারের সদস্যরাই নন, গ্রামের পুরুষ, মহিলারা সুসজ্জিত হয়ে কলাবউকে স্নান করাতে নিয়ে যান। পুরোহিতের হাতে থাকে কলাবউ। শোভাযাত্রার প্রথমেই থাকেন পুরোহিত। অষ্টমীতে সন্ধিপুজো। এই দিনটি সকলের কাছেই অতি রোমাঞ্চকর। কারণ, এক কোপে চারটে পাঁঠা বলি হয়। মন্দিরের সামনে বলির জন্য সব সময় একটি হাঁড়িকাঠ থাকে। সন্ধিপুজোর আগে তারই পাশাপাশি আরও তিনটি হাঁড়িকাঠ রাখা হয়। খড়্গ হাতে চার জনই প্রস্তুত, তারা অপেক্ষা করছেন পুরোহিতের ঘন্টা বাজানোর জন্য। পুরোহিত নির্দিষ্ট নির্ঘন্ট মেনে ঘন্টা বাজালেন। সঙ্গে সঙ্গে চারটে খড়্গ এক সঙ্গে পড়ল চারটি পাঁঠার ঘাড়ে! অষ্টমীতে কিন্তু ওই চারটি ছাড়া আর অন্য কোনও বলি হয় না। নবমীর দিনেও বলি হয়। যত মানুষ মানত করেন, তাঁদের মানসিকের ছাগ বলি হয় নবমীতে। এক টানা আনন্দ শেষে দশমীতে বিসর্জন। পরিবারের সকলে মাথায় ঘট নিয়ে মায়ের ঘট পুকুরে বিসর্জন দিতে যান বাদ্যি বাজিয়ে। তবে বাজনার সুরে সে দিন আনন্দ থাকে না, থাকে বিষাদের সুর।
ভোগ বিশেষত্ব
পুজোর ক’দিন নৈবেদ্যর থালায় ভরে ওঠে মণ্ডপ। নৈবেদ্য হয় আতপ চালের। গাওয়া ঘিয়ে ভাজা লুচি, নারকেল নাড়ু আর মিষ্টিও থাকে। মায়ের ভোগে খিচুড়ি, তরকারি, পায়েস সপ্তমী থেকে নবমীর দিন পর্যন্ত দেওয়া হয়।
No comments:
Post a Comment