কলকাতা, হাওড়া সহ পশ্চিমবঙ্গের নানা অজানা প্রয়োজনীয় তথ্য তুলে ধরার সামান্য প্রচেষ্টা। পাঠকদের ভালো লাগলে খুশি হব।
Wednesday, October 5, 2011
Tuesday, October 4, 2011
Durga Puja Story
দশমীতে দেবী দর্শনের সুযোগ পান লক্ষ্মীপুরের বাসিন্দারা
দেবাশিষ বন্দ্যোপাধ্যায়
ঢাক বাজছে বাংলাদেশের মাশলিয়া গ্রামে। এ পার বাংলার বাগদার লক্ষ্মীপুর গ্রামের বাসিন্দারা খুশি, পুজো শুরু হয়ে গিয়েছে। দেবী দর্শনের জন্য আরও তিন দিন অপেক্ষা করতে হবে।
দশমীতে মাশলিয়ার প্রতিমা বিসর্জন হয় কপোতাক্ষ নদে। যে নদের উল্টো দিকে লক্ষ্মীপুর। মা দুর্গাকে বিসর্জন দিতে হবে বলে মাশলিয়ার গ্রামবাসীদের যখন মন খারাপ, তখন দশভূজা দর্শনে হাসি ফোটে লক্ষ্মীপুরের বাসিন্দাদের মুখে। তবে, এই সৌভাগ্যও লক্ষ্মীপুরের বাসিন্দাদের প্রতি বছর হয় না। যে বছর কপোতাক্ষ কচুরিপানায় ভরা থাকে, সে বছর মাশলিয়ার প্রতিমা অন্যত্র বিসর্জন দেওয়া হয়। এ বার অবশ্য এখনও কচুরিপানার দেখা মেলেনি ওই নদে। তাই গ্রামবাসীরা দেবী দর্শনের আশায় রয়েছেন।
গ্রাম না বলে উত্তর ২৪ পরগনার বাগদার লক্ষ্মীপুরকে দ্বীপ বলাই ভাল। সীমান্তঘেঁষা গ্রামটির তিন দিক ঘিরে রয়েছে কপোতাক্ষ। নদীর উল্টো পাড়ে, পূর্ব দিকে বাংলাদেশের সাহাজাদপুর, দক্ষিণ দিকে কাবিলপুর এবং উত্তর দিকে মাশলিয়া। বনগাঁ শহর থেকে লক্ষ্মীপুরের দূরত্ব অন্তত ৩৫ কিলোমিটার। প্রায় ৭০টি পরিবারের বাস। বেশির ভাগ গ্রামবাসী খেতমজুরি বা দিনমজুরি করে সংসার চালান। মাস দুয়েক হল গ্রামে বিদ্যুৎ এসেছে। একটি প্রাথমিক স্কুল রয়েছে। ব্যস্, এই টুকুই। স্বাস্থ্যকেন্দ্র নেই, দোকানপাট নেই, গভীর নলকূপও নেই। সর্বত্রই অনুন্নয়নের ছবি স্পষ্ট। নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র আনতে গ্রামবাসীদের বনগাঁ বা বাগদা বাজারে যেতে হয়। আসা-যাওয়ার পথে অনুমতি নিতে হয় গ্রামের বাইরে থাকা ক্যাম্পের বিএসএফ জওয়ানদের। শুধু নীল আকাশে সাদা তুলোর মতো মেঘ এবং বিলে শাপলা ফুটতে দেখলে গ্রামবাসীরা বুঝতে পারেন, পুজোর সময় কাছে এল।
নুন আনতে যাঁদের পান্তা ফুরোয়, তাঁরা পুজোর আয়োজনের কথা ভাবতেই পারেন না। কাছাকাছি পুজো বলতে দু’কিলোমিটার দূরে বয়রা বাজারের পুজো। তবে, সেখানকার ঢাকের শব্দ লক্ষ্মীপুরে পৌঁছয় না। গ্রামবাসীরাও সেখানে বড় একটা যান না। তাঁরা একাত্ম হন মাশলিয়ার পুজোর সঙ্গেই। জনা কয়েক যুবক অবশ্য বনগাঁয় পুজো দেখতে যান। বাকিরা গ্রামেই থেকে যান। অপেক্ষা করেন দশমীর জন্য। গ্রামের কল্যাণী মজুমদারের কথায়, “বিসর্জনের সময়ে মাশলিয়ার মানুষরা আমাদের আমন্ত্রণ জানান। আমরা গিয়ে মাকে সিঁদুর পরাই। বরণ করি। প্রণাম করি। ওই একটা দিনই আমাদের আনন্দ।”
দশমীতে মাশলিয়ায় ঢাকের আওয়াজ যত তীব্র হয়, লক্ষ্মীপুরে কপোতাক্ষের ধারে তত ভিড় জমে। বিকাল নাগাদ মাশলিয়ার প্রতিমা নৌকায় তুলে কপোতাক্ষ নদে বেশ কিছুক্ষণ ঘোরানো হয়। ব্যস, ওই এক দিনেই লক্ষ্মীপুরে পুজোর আনন্দের শুরু এবং শেষ। এ বছর অতি বর্ষণে খেত জলে ডুবে যাওয়ায় নষ্ট হয়েছে চাষ। তাই গ্রামের বেশির ভাগ কচিকাঁচারই নতুন জামাকাপড় হয়নি। তা নিয়ে তাদের বিশেষ কষ্টও নেই। দারিদ্রে তারা অভ্যস্ত। সপ্তম শ্রেণির আশিস বিশ্বাস তাই অনায়াসেই বলে, “বাবার এ বার ক্ষতি হয়ে গিয়েছে। কী ভাবে নতুন জামা চাইব?” তবে, দশমীতে গ্রামের সকলের সঙ্গে সে-ও মাশলিয়ার প্রতিমা দেখবে বলে জানিয়েছে।
কিন্তু যে বার ওই নদে বিসর্জন হয় না?“সে বছর আর প্রতিমা দেখা হয় না। ঢাকের আওয়াজ যে দিন আর শোনা যায় না, বুঝতে পারি, পুজো শেষ” বললেন গ্রামের বিমল বালা। গ্রাম থেকে যে দু’এক জন বনগাঁয় পুজো দেখতে যান, ফিরে এসে তাঁরা সেই গল্প করেন। তা শুনেই তৃপ্ত হন গ্রামবাসীরা।
Durga Puja Story for Kids
মা দুগ্গার গল্প - দেবাশিষ বন্দ্যোপাধ্যায়
বহু যুগ আগের কথা। পুরাকালের কোনও এক সময়ে মহিষাসুর নামে এক মহা পরাক্রমশালী অসুর তার অসম্ভব দাপট এবং হিংস্রতায় একে একে অধিকার করল মর্ত ও পাতাল। তার দম্ভ এবং লোভ তখন আকাশছোঁয়া। কাজেই স্বর্গ বিজয় করে সে ত্রিলোকের অধীশ্বর হতে চায়। চায় সর্বশক্তিমান ও ক্ষমতাবান হতে। মহিষাসুরের পৈশাচিক হিংস্রতা ও ক্ষিপ্রতার কাছে হার মেনে নিয়েছে প্রায় সকলেই। এমনকী দীর্ঘদিনের যুদ্ধের পর দেবতাদের পরাস্ত করে মহিষাসুর তাঁদের তাড়িয়ে দিলেন স্বর্গ থেকে। মুনি ঋষিরাও ছাড় পেলেন না সেই অত্যাচার থেকে।
বিতাড়িত দেবতারা তখন সর্ব ক্ষমতার অধীশ্বর ত্রিদেব অর্থাৎ ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বরের কাছে উপস্থিত হলেন। প্রজাপতি ব্রহ্মা জানালেন, কঠোর তপস্যাবলে মহিষাসুর তাঁরই কাছ থেকে বর লাভ করেছে যে ত্রিভূবনের কোনও পুরুষই তাকে পরাস্ত করতে পারবে না।
তাহলে উপায়?
মহিষাসুরের পাশবিক অত্যাচারের কাহিনি শুনে ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বর খুবই রেগে গেলেন। ত্রিদেবের সেই ক্রোধাগ্নির প্রচণ্ড তেজ ও দেবতাদের সম্মিলিত রোষে আশ্বিন মাসের কৃষ্ণা চতুর্দশী তিথিতে হিমালয়ের শীর্ষে ঋষি কাত্যায়নের আশ্রমে সৃষ্টি হল এক ‘নারী’।নামকরণ হল দুর্গা। ঋষি কাত্যায়নের আশ্রমে এই সৃষ্টিকার্য হয়েছিল বলে দেবী দুর্গার আর এক নাম রাখা হল ‘কাত্যায়নী’।
অমাবস্যা-পরবর্তী শুক্লপক্ষের সপ্তমী, অষ্টমী ও নবমী তিথিতে ঋষি কাত্যায়ন দেবীর আরাধনা করলেন। দেবীর পুজো এবং স্তুতি চলাকালীন সকল দেবতারা তাঁদের সমস্ত শক্তি ও অস্ত্র দেবীকে প্রদান করলেন। যেমন, হিমালয় দেবীকে দিলেন তাঁর বাহন সিংহ। ব্রহ্মা দিলেন কমণ্ডলু। দেবরাজ ইন্দ্র দিলেন বজ্র। কুবেরের গদা, বিষ্ণুর চক্র আর মহাদেবের কাছ থেকে দেবী দুর্গা পেলেন পেলেন ত্রিশুল। দেবী হলেন দশভুজা, যিনি সর্ব শক্তির অধিকারী। দেবীর রণ হুঙ্কারে ত্রিলোক কাঁপতে লাগল। সঙ্গে যুক্ত হল তাঁর বাহনের সিংহনাদ। দেবী দুর্গা প্রবল পরাক্রমে এবং কৌশলের সঙ্গে ভয়ানক হিংস্র অসুরবাহিনীকে পরাজিত করলেন। কিন্তু বাকি রইল শুধু মহিষাসুর, এ বার তার পালা।
দেবী যুদ্ধে আহ্বান করলেন মহিষাসুরকে। শুরু হল মহিষাসুর এবং দেবী দুর্গার সমর। সে এক ভয়ঙ্কর যুদ্ধ! দেবী ও মহিষাসুরের দৃপ্ত, উন্মত্ত পদ চালনায় স্বর্গ-মর্ত-পাতাল কাঁপতে থাকল। মহিষাসুর নানা রূপ ধারণ করে, নানা ছলে, কৌশলে দেবীকে বিব্রত ও বিমোহিত করার চেষ্টা করতে লাগল। কিন্তু দেবী ধীরে ধীরে তার সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে প্রচণ্ড হুঙ্কারে ত্রিশুল দিয়ে বধ করলেন মহাপরাক্রমী মহিষাসুরকে। পুরাণ মতে দশমীতে দেবী দুর্গা মহিষাসুরকে বধ করেন।
প্রলয় তখন থেমে গিয়েছে। সকল দেবতারা একত্রিত হয়ে দেবী দুর্গার জয়ধ্বনি করতে লাগলেন। চতুর্দিকে পুষ্পবৃষ্টি হচ্ছে। দেবতারা আবার স্বর্গের অধিকার ফিরে পেলেন।
দুষ্টের দমন ও শান্তি স্থাপনে মানুষ ও দেবতারা বার বার দেবী দুর্গার শরণাপন্ন হয়েছেন। যেমন, কৃত্তিবাসী রামায়ণে পত্নী সীতাকে উদ্ধার ও রাবণ বধের জন্য ব্রহ্মা শ্রীরামচন্দ্রকে দেবী দুর্গার আরাধনার পরামর্শ দিয়েছিলেন। সেই মতো শ্রীরামচন্দ্র করেছিলেন দেবীর অকাল বোধন। ষষ্ঠী, সপ্তমী এবং অষ্টমী তিথিতে চণ্ডীপাঠ করে রামচন্দ্র দেবীর আরাধনা করেন। কিন্তু সমস্যা হল, মহাষ্টমী ও মহানবমীর সন্ধিক্ষণে এসে। তখন সন্ধিপুজোর সময়, সে জন্য ১০৮টি নীল পদ্ম জোগাড় করে এনেছিলেন হনুমান। কিন্তু রামকে পরীক্ষা করার জন্য দেবী একটি পদ্ম মায়াবলে লুকিয়ে ফেললেন। সেই একটি পদ্ম না পেয়ে উদ্বিগ্ন রামচন্দ্র পুজোর আয়োজন সম্পূর্ণ করতে নিজের ‘আঁখিপদ্ম’ উৎপাটনে উদ্যত হলে দেবী দুর্গা প্রকট হলেন। রামচন্দ্রের ভক্তি ও নিষ্ঠায় সন্তুষ্ট হয়ে দেবী তাঁকে রাবণ বধের বর প্রদান করলেন। মহাযুদ্ধের পর মহাপরাক্রমী রাবণের বিরুদ্ধে রামচন্দ্র ও তাঁর বানরসেনা জয়লাভ করল। দেবীর অকাল বোধনের এই ধারাকেই অনুসরণ করে বছর বছর ধরে আশ্বিন মাসে পালিত হয়ে আসছে বাঙালির অন্যতম মহোৎসব দুর্গাপুজো যা আজ দেশ-কালের গণ্ডি পেরিয়ে এখন আন্তর্জাতিক রূপ পেয়েছে। এটি বাঙালি সভ্যতা ও সংস্কৃতির এক মিলন উৎসবও বটে। বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী এই দুর্গাপুজোর ইতিহাস খুব প্রাচীন নয়। দুর্গাপুজোর যে রূপ আমরা দেখি তার সময়কাল খুব বেশি হলে পাঁচশো বছরের কাছাকাছি। কিন্তু এই আরাধনার ব্যাপ্তি খুব দ্রুত হয়েছে বলে এখন এই পুজো মহোৎসবে পরিণত হয়েছে।
Monday, October 3, 2011
Durga Puja of Midnapur
মেদিনীপুর
কিশোরনগর গড়ের দুর্গাপুজো - দেবাশিষ বন্দ্যোপাধ্যায়
শোনা যায়, অনেক বছর আগে গভীর রাতে এক ষোড়শী মশাগাঁর খাল (বর্তমান সাতমাইল খাল) পার হওয়ার জন্য মাঝিকে অনুরোধ করে। মাঝি রাজি না হওয়ায় কিছু দূরে ছেলেদের কাছে গিয়ে ওই ষোড়শী বলে, ‘‘কিশোরনগরে আমার বাবার বাড়ি। খাল পার করে দিলে তোমরা যা চাইবে তাই দেব।’’ ছেলেরা খাল পার করে দিলে ষোড়শী বলে, ‘‘নৌকার পাশে মাটি খুঁড়লে সব জানতে পারবে।’’ এ কথা বলেই ষোড়শী অদৃশ্য হয়ে যায়। পর দিন ছেলেরা মাটি খুঁড়ে মায়ের সংকীর্তনের বই পায়। ছেলেরা তার পর রাতে মায়ের স্বপ্নাদেশ পায়, ‘‘আমার মন্দিরে বসে গান কর। আর রাজাকে বলবি মশাগাঁ খালের নীচে তামার থালায় আমার খড়্গ আছে। রাজার লোকেরা জলের নীচে নামলেই পাবে।’’ পর দিন ছেলেরা রাজাকে সব ঘটনা জানিয়ে মন্দিরে গান করতে চাইলে রাজা তাতে রাজি হলেন না। ছেলেরা মন্দিরের পেছনে পশ্চিম দিকে গিয়ে মনের দুঃখে গান জুড়তেই মায়ের মন্দিরের পুজোর ঘট আপনি আপনি পশ্চিমমুখী হয়ে যায়। সেই থেকে আজও কিশোরনগর গড়ের দুর্গাপুজোর ঘট পশ্চিমমুখী।
পুজোর শুরু
প্রায় তিনশো বছরের প্রাচীন দুর্গাপুজো। কিশোরনগর গড়ের দুর্গাপুজোর অন্যতম বৈশিষ্ট্য পঞ্চ ব্রাহ্মণের মাথার উপর স্থাপিত বেদীতে মায়ের অধিষ্ঠান। রাজবাড়ির বর্তমান সদস্য কৃষ্ণ রায় চৌধুরীর কথায়, বাংলার নবাব আলিবর্দি খাঁর অধীনস্ত জমিদার ছিলেন রাজা যাদবরাম রায় চৌধুরী। তিনিই পাঁচ ব্রাহ্মণের মাথা মাটির নীচে পুঁতে মায়ের বেদী তৈরি করেন। আজও সেই বেদীর উপর মায়ের অধিষ্ঠান।
পুজোর বৈশিষ্ট্য
কিশোরনগর গড়ে শাক্ত মতে প্রতিপদ থেকে দশমী পর্যন্ত দশ দিন ব্যাপী পুজো হয়। সপ্তমী থেকে দশমী পর্যন্ত মায়ের বেদীর পাশে শোভা পায় মশাগাঁ খাল থেকে পাওয়া সেই তামার থালা ও খড়্গ। হোমের আগুন জ্বালানো হয় সম্পূর্ণ বৈদিক মতে। সূর্যের আলোকে আতসকাচের মাধ্যমে হোমের আগুন জ্বালানো হয়। সেই সময়ে ৫টি মহিষ আর ৫১টি পাঁঠাবলির নিয়ম চালু থাকলেও বর্তমানে পশুবলি প্রথা তুলে দেওয়া হয়েছে। জীর্ণ রাজবাড়ির মতো জরাজীর্ণ মায়ের মাটির মন্দির, খড়ের আটচালা। এটা নাকি মায়েরই নির্দেশ! তাই মাটির মন্দির আর খড়ের আটচালাতেই পূজিত হচ্ছেন তিনি।
ভোগ বিশেষত্ব
এই পুজোয় সেরা ভোগ কাজু বাদামের সন্দেশ। দুই কুইন্ট্যাল কাজুর সঙ্গে উপযুক্ত পরিমাণে ছানা ও চিনি মিশিয়ে ঘরোয়া পদ্ধতিতে তৈরি করা হয় এই সন্দেশ। পুজোর দিনগুলোতে আগত দর্শনার্থীরা ৫-৩০ টাকার কুপনের মাধ্যমে এই কাজুবাদামের সন্দেশ কিনেও থাকেন। এ ছাড়া পুজোর প্রতিদিনই নিরামিষ ভোগের আয়োজন থাকে। সেখানে ভাত, ছোলা বা মুগের ডাল, নানাবিধ তরিতরকারির পদ ও ভাজাভুজি হয়ে থাকে। আগে ১০৮টি পাঁঠা ও মহিষ বলি হত, এখন এই প্রথা উঠে গেছে।
Durga Puja of Midnapur
মেদিনীপুর
পরমানন্দপুরের ঘোষ পরিবারের দুর্গাপুজো - দেবাশিষ বন্দ্যোপাধ্যায়
পুজোর শুরু
১২০৯ সালের ঘটনা। গৃহদেবতা থাকায় আলাদা মণ্ডপ করা যাবে না। আবার বাঙালির সবচেয়ে বড় উৎসব দুর্গা পুজো, তাও করতে হবে। কিন্তু কী ভাবে? পুরোহিতেরা বিধান দিলেন, গৃহদেবতার মন্দিরেই মাটির ‘ঘট’-কে দেবী দুর্গা রূপে পুজো করা হবে। সেই থেকে পুরুষানুক্রমে গৃহদেবতা রঙ্কিনী মাতার মন্দিরে এ ভাবেই দুর্গাপুজো করে আসছেন পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার চন্দ্রকোনা থানা এলাকার পরমানন্দপুর গ্রামের ঘোষ পরিবার। এখনও সেই রীতির কোনও পরিবর্তন ঘটেনি।
পুজোর বৈশিষ্ট্য
যদুনাথ ঘোষের চালু করা এই পুজোর এক একটি দিনের বিশেষত্ব এক এক রকম। ঘোষ বংশের সুশীল ঘোষ, রাজকুমার ঘোষেরা বলেন, “বংশ পরম্পরায় এ ভাবেই পুজো চলে আসছে। পুজোর আচার-আচরণে কোনও পরিবর্তন হয়নি। পুজো হয় পুরনো রীতি মেনেই।”
পুজো শুরু হয় প্রতিপদ অর্থাৎ মহালয়ার পর দিন থেকে। সে দিনই ঘট বসানো হয় মন্দিরে। পুকুর থেকে ঘট মাথায় করে রঙ্কিনী মন্দিরে নিয়ে যান পুরোহিত। তার সঙ্গে থাকে ঢাকের বাদ্যি, শঙ্খধ্বনি, উলুধ্বনি। সেই দিন থেকেই প্রতিদিন চণ্ডীপাঠ হত আগে। বর্তমানে অবশ্য পুজোর ক’দিনই চণ্ডীপাঠ হয়। ষষ্ঠীতে হয় বেলবরণ। পুকুরের ধারেই রয়েছে একটি বেল গাছ। সেই বেলগাছকে দেবী রূপে পুজো করা হয়। সপ্তমীতে কলাবউ স্নান। শিকড়-সহ কলাগাছ তুলে নিয়ে আসা হয়। সুন্দর হলুদ শাড়ি পরানো হয়। কেবল ঘোষ পরিবারের সদস্যরাই নন, গ্রামের পুরুষ, মহিলারা সুসজ্জিত হয়ে কলাবউকে স্নান করাতে নিয়ে যান। পুরোহিতের হাতে থাকে কলাবউ। শোভাযাত্রার প্রথমেই থাকেন পুরোহিত। অষ্টমীতে সন্ধিপুজো। এই দিনটি সকলের কাছেই অতি রোমাঞ্চকর। কারণ, এক কোপে চারটে পাঁঠা বলি হয়। মন্দিরের সামনে বলির জন্য সব সময় একটি হাঁড়িকাঠ থাকে। সন্ধিপুজোর আগে তারই পাশাপাশি আরও তিনটি হাঁড়িকাঠ রাখা হয়। খড়্গ হাতে চার জনই প্রস্তুত, তারা অপেক্ষা করছেন পুরোহিতের ঘন্টা বাজানোর জন্য। পুরোহিত নির্দিষ্ট নির্ঘন্ট মেনে ঘন্টা বাজালেন। সঙ্গে সঙ্গে চারটে খড়্গ এক সঙ্গে পড়ল চারটি পাঁঠার ঘাড়ে! অষ্টমীতে কিন্তু ওই চারটি ছাড়া আর অন্য কোনও বলি হয় না। নবমীর দিনেও বলি হয়। যত মানুষ মানত করেন, তাঁদের মানসিকের ছাগ বলি হয় নবমীতে। এক টানা আনন্দ শেষে দশমীতে বিসর্জন। পরিবারের সকলে মাথায় ঘট নিয়ে মায়ের ঘট পুকুরে বিসর্জন দিতে যান বাদ্যি বাজিয়ে। তবে বাজনার সুরে সে দিন আনন্দ থাকে না, থাকে বিষাদের সুর।
ভোগ বিশেষত্ব
পুজোর ক’দিন নৈবেদ্যর থালায় ভরে ওঠে মণ্ডপ। নৈবেদ্য হয় আতপ চালের। গাওয়া ঘিয়ে ভাজা লুচি, নারকেল নাড়ু আর মিষ্টিও থাকে। মায়ের ভোগে খিচুড়ি, তরকারি, পায়েস সপ্তমী থেকে নবমীর দিন পর্যন্ত দেওয়া হয়।
Durga Puja of Hooghly
হুগলি
আরামবাগ খামারবেড় গ্রামের দুর্গাপুজো - দেবাশিষ বন্দ্যোপাধ্যায়
দেবীপক্ষ থেকে রামায়ণ গান দিয়ে দুর্গাপুজোর শুরু। আরামবাগের খামারবেড় গ্রামের ১৩ ঘর ভট্টাচার্য পরিবারের এই পুজো ১৩-১৪টি গ্রামের আকর্ষণ। দশমী পর্যন্ত দেবীর আটচালায় রামায়ণ গান চলে। ব্যতিক্রম হলেই ক্ষমা নেই। শরিকদের কারও কিংবা গায়কের মুখ দিয়ে রক্ত উঠবে। পূজায় মন্ত্র উচ্চারণ বা পূজা সংক্রান্ত আচার-আচরণে ত্রুটি থাকলে সঙ্গে সঙ্গে মুখ দিয়ে রক্ত ওঠা, অসুস্থ হয়ে যাওয়ার হাজার রোমহর্ষক কাহিনি ছড়িয়ে আছে খামারবেড়ের এই পুজোকে কেন্দ্র করে।
পুজোর শুরু
এলাকায় ‘জাগ্রত’ বলে বিশেষ খ্যাত এই দুর্গাপুজোর বয়স ৫০০ বছর বলে দাবি করেছেন ভট্টাচার্য পরিবারের বয়স্করা। শ্রদ্ধা-ভক্তি এবং আতঙ্কের মিশেলে পারিবারিক প্রাচীন পুজোটি ক্রমশই সর্বজনীন পুজোর রূপ নিয়েছে।
পুজোর বৈশিষ্ট্য
সন্ধিপুজোর সময় বহু দূর দূরান্ত গ্রাম জয়রামপুর, বলরামপুর, বলুণ্ডি, কাষ্ঠদহি ইত্যাদি থেকে পুজো দেখতে আসেন মানুষ। অষ্টমী এবং নবমীর দিন পুজোপ্রাঙ্গণে কয়েক হাজার ভক্তের মধ্যে হতাশাগ্রস্ত এবং অসুস্থ মানুষের লাইন পরে যায় মায়ের পুজোর প্রসাদী ফুল সংগ্রের জন্য। সন্ধিপুজোয় দুর্গা - কালি হিসাবে পূজিত হন বলেই দুর্গার চার হাত, জানালেন ভট্টাচার্যরা। দুর্গার চারহাতে থাকে ত্রিশূল, চক্র, খড়্গ এবং সাপ।
ভোগ বিশেষত্ব
মহাষ্টমীর দিন মায়ের প্রসাদ হিসেবে ‘ভাত ভোগ’ হয়। রামায়ণ গায়ক প্রতিবছর একাদশী তিথিতে ‘রামরাজা’ গান শেষ করে মায়ের কাছে প্রতিজ্ঞা করবেন ‘আসর ছেড়ে, মাগো যদি আমি অন্য আসরে গান গাই, মোর মাথা খাও তোমায় শিবের দোহাই’। এর পর দোহাই দিতে হয় মূর্তি শিল্পী এবং ঢাকিকেও। পূজারি ভট্টাচার্যরা নিজেরাই অন্যের অপরাধের আশঙ্কায় ১৩ ঘর ভট্টাচার্যর আবালবৃদ্ধবনিতা সকাল-সন্ধ্যা দু’বেলা প্রতিপদ থেকে ১০ দিন নাকখত দেবেন দেবীর আটচালায়।
সপ্তমী, অষ্টমী এবং নবমী তিন দিনই পাঁঠা বলি হয়। পাঁঠা যোগাড়ে, কলা পাতা, বেল পাতা যোগাড়ে পর্যন্ত বংশানুক্রমে চলে এই পুজোয়। অন্য কোথাও উপার্জনের বেশি সম্ভাবনা থাকলেও দেবীর কোপে পড়ার আতঙ্কে রামায়ণ গায়ক থেকে শুরু করে বেলপাতা যোগাড়ে পুজোর দিনগুলো খামারবেড়ের জন্য ফাঁকা রাখেন। দশমীর দিন প্রতিমা বিসর্জন হয় গ্রামের পুকুরে ‘দুর্গার ঘাট’-এ। পুকুরের এই ঘাট সারাবছর সংরক্ষিত রাখা হয়। ঘাট সরানো নিষেধ। বিসর্জন পর্ব শুরু হয় কলা বৌ-এর বিসর্জন দিয়ে। বিসর্জন পর্ব শেষ হলে মহিলাদের কান্নাকাটি করার রীতি আছে।
Durga Puja of Hooghly
হুগলি
আরামবাগ ময়াল গ্রামের ‘জলকর’ রায় পরিবারের দুর্গাপুজো - দেবাশিষ বন্দ্যোপাধ্যায়
পুজোর শুরু
সদগোপ প্রধান ময়াল গ্রামের রায় পরিবারের পূর্বপুরুষরা, দ্বারকেশ্বর নদ থেকে শুরু করে তমলুক পর্যন্ত বিভিন্ন নদনদী থেকে জলকর আদায়ের কাজে নিযুক্ত ছিলেন। এবং এই জলকরের আয় থেকেই পুজোর সূচনা হয়েছিল বলে জানান গ্রামের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক মোহনলাল রায়। সেই আমলের এই নবাবী আদেশনামার জন্যই নাম হয় ‘জলকর রায়’। জ্ঞাতিভাইয়ের এই শরিকি পুজোর খরচের প্রায় ৫০ হাজার টাকা আসে দেবত্র জমিজমা এবং দু’টি পুকুরের মাছ চাষ থেকে।
পুজোর বৈশিষ্ট্য
এই দুর্গা প্রতিমার হাত দু’টি, মহিষাসুর নেই। ডাকের সাজে সজ্জিত। চালচিত্রের উপর বিভিন্ন দেবদেবীর চিত্র আঁকা। রীতি হল প্রতিমার মূর্তির মুখের আদল একই রকম হবে। পুরুষানুক্রমে কুমোররা মূর্তি গড়েন এখানে। ‘জলকর’ রায়বাড়ির দুর্গাপুজো শুরু হয় জিতাষ্টমীর পরের দিন। প্রায় ৩০০ বছরের প্রাচীন পুজোটি এই নিয়মেই হয়ে আসছে বরাবর। পুজোর আড়ম্বর শুরু হয় প্রতিপদ থেকেই। এ দিন পরিবারের কুলপুরোহিত অষ্টধাতুর ভুবনেশ্বরী মাতার মূর্তি মূলমন্দির থেকে এনে দুর্গাদালানে স্থাপন করেন। লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক ও গণেশের মূর্তি অবশ্য মাটির। পারিবারিক এই পুজোয় কুমড়ো বলির সঙ্গে ছাগ বলি প্রথা আছে। সম্প্রতি ছাগ বলির নির্মম প্রথাটি বন্ধের জন্য স্থানীয় কিছু মানুষজন চেষ্টা চালাচ্ছেন। পুজোর ক’টা দিন নাড়ু, মুড়কি, ফল, মিঠাই বিতরণ পুজোটিকে মহোৎসবে পরিণত করে। তিনশো বছরের এই পুজোর একটিমাত্র রীতি পালন করা যাচ্ছে না বলে আক্ষেপ জলকর রায় পরিবারের। প্রথা ছিল প্রতিমা বিসর্জনের পর শঙ্খচিল দর্শন করে ঠাকুরদালানে ফিরতে হবে। কিন্তু গ্রামে এখন শঙ্খচিল বিলুপ্ত। অগত্যা ‘শঙ্খচিলের স্মরণ’ নিয়ে নদী ঘাট থেকে ফিরে আসতে হয়। বিসর্জনের পর রায়পরিবারের প্রত্যেককে বিল্বপত্রে লাল কালি দিয়ে দুর্গা নাম লিখতে হয়। তার পর শান্তিজল নেওয়ার পর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান দিয়ে উৎসব শেষ হয়।
Durga Puja of Mushidabad
মুর্শিদাবাদ
নতুনবাজার সেনবাড়ির দুর্গাপুজো - দেবাশিষ বন্দ্যোপাধ্যায়
অবিভক্ত বাংলার সাবজজ্ রাধাকৃষ্ণ সেন বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজের প্রথম এফ.এ। তাঁর বাল্যবিধবা কন্যা বিন্দুবাসিনী মাতৃ আরাধনার আর্জি করলেন। কন্যার আবদার মেনে নিলেন তিনি। ১১৫ বছর আগে সেনবাড়ির এই মন্দিরে দেবী চণ্ডীর বদলে পূজিত হতেন দেবী জগদ্ধাত্রী। রাধাকৃষ্ণ সেনের বর্তমান প্রজন্ম সুবীর সেন বলেন, “সেই থেকে সেনবাড়ির জগদ্ধাত্রী রূপান্তরিত হলেন দেবীদুর্গায়। আসলে যিনি জগদ্ধাত্রী তিনিই তো দেবীদুর্গা।”
পুজোর শুরু
নতুনবাজার এলাকার ৩ নম্বর গিরিজা চক্রবর্তী লেনের সেনবাড়ির দেবীদুর্গার আরাধনা শুরু হয় ১৮৯৬ সালে।
পুজোর বৈশিষ্ট্য
সেনবাড়ির দেবীদুর্গা কিন্তু তাঁর চতুর্থ হাত দিয়ে অসুর বধ করেন।
বাড়ির মন্দিরের বেদীতেই রথের দিন কাঠামো পুজো হয়। ভাদ্র মাসে ঠাকুর তৈরির কাজ পুরোপুরি বন্ধ থাকে। অসুর হয় সবুজ রঙের। আসলে মহিষাসুরের বদলে প্রতীকস্বরূপ দেবীর পায়ের কাছে মহিষের ছোট্ট একটি মাথা থাকে। একচালার সাবেকি প্রতিমার পুজো হয় বৈষ্ণব মতে। তবে ষষ্ঠী ও সপ্তমীতে গঙ্গায় ঘট ভরতে যাওয়ার সময় বাড়ির কোনও সধবাকে কাঁখে ঘটি নিয়ে বাড়ির মূল দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। পুরোহিত ওই মহিলার সামনে দিয়ে ঘট ভরতে যান গঙ্গায়। সাত রকমের গোটা ফল, বেলপাতা ও শোলার কদমফুল দিয়ে তৈরি করা হয় পুজোর ‘রচনা’। সন্ধিপুজোর শুরু ও শেষের সময় গুলি ছোঁড়ার রেওয়াজ ছিল। বরাবরের এই রেওয়াজ বন্ধ হয়ে গিয়েছে প্রায় কুড়ি বছর আগে।
ভোগ বিশেষত্ব
ভোগেরও বিশেষত্ব রয়েছে সেনবাড়ির পুজোয়। ভোগের মেনুতে ৫৫টি লুচির সঙ্গে থাকবে পাঁচ রকমের তরকারি, শাক, আলু ও পটল ভাজা। নবমীর ভোগে কাঁচকলা ভাজা, কাঁচকলার টক ও বাড়িতে তৈরি নারকেল নাড়ু ‘মাস্ট’। এ ছাড়া প্রতিদিন ছানা, দই ও মিছরি তো থাকেই। দেওয়া হয় আতপ চালের নৈবেদ্য । তবে সপ্তমী, অষ্টমী ও নবমী পুজোয় আতপ চালের ১৭টি নৈবেদ্য দেওয়া হলেও সন্ধিপুজোয় আতপ চালের ১৯টি নৈবেদ্যের প্রয়োজন।
Durga Puja of Mushidabad
মুর্শিদাবাদ
ডোমকলের পালবাড়ির অকালবোধন - দেবাশিষ বন্দ্যোপাধ্যায়
জমিদার বাড়ির পুজো বলে কথা। ১০৮ ঢাকে কাঠি পড়লেই এলাকার পাঁচটা গাঁয়ের মানুষ বুঝে যেত পাল বাবুদের বাড়িতে মায়ের আবির্ভাব ঘটেছে। গ্রামবাসীদের কথায় জমিদারি না থাকলেও পাল পরিবারের কর্তারা এখনও আছেন গ্রামে। নেই কেবল ১০৮ ঢাকি আর তার মন কাড়া বোল।
পুজোর শুরু
অবিভক্ত ভারতের ময়মনসিংহের আনন্দমোহন কলেজের অধ্যাপক ছিলেন পরিবারের কর্তা শরৎচন্দ্র পাল। ডোমকলের বাজিতপুর গ্রামে তিনিই ১০৮ বছর আগে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন পারিবারিক পুজোর। পরিবারের ছোট ছেলে গোপালকৃষ্ণ পাল বলেন, “এ বার আমাদের পুজো ১০৮ বছরে পা রাখল। এ বছরটাই ১০৮ ঢাকির কথা বার বার মনে পড়ছে। ওরা মিছিল করে নাচতে নাচতে আসত ক’টা দিন মহানন্দে কাটিয়ে ঘরে ফিরত। ওদের মধ্যে এত ভাল ঢাকি ছিল যে তাদের ঢাকের শব্দ শুনলেই মানুষ বলে দিত অমুক ঢাকি এসেছে।”
পুজোর বৈশিষ্ট্য
১০৮ জন ঢাকির সম্মিলন এই পুজোর অন্যতম বৈশিষ্ট্য। অধ্যাপক শরৎবাবু ছিলেন সংস্কারমনা। তিনি নারী এবং দলিত শ্রেণিকে গুরুত্ব দিতেন। তার লক্ষ্য ছিল অসংগঠিত ঢাকিদের সংগঠিত করা। পুজোর ক’টা দিনে আনন্দটা যেন তারাও গায়ে মাখতে পারে সে দিকে লক্ষ রেখে ১০৮ ঢাকির ব্যবস্থা। এই পুজোতে দেবী দুর্গার সঙ্গে দেখা মেলে রাম-লক্ষ্মণ-বিভীষণ-হনুমান ও জাম্বুবানের। প্রতিষ্ঠা বর্ষে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে একাদশীতে বিসর্জন হয়েছিল এই পুজোর। আর তার পর থেকে সেটাই নিয়মে পরিণত হয়েছে। প্রতি বছর একাদশীতেই বিসর্জন হয় প্রতিমার।
ভোগ বিশেষত্ব
পুজোতে অন্নভোগ হয় না। লুচি, তরকারি, মণ্ডা, নাড়ু এ সবই প্রসাদ।
Durga Puja of Mushidabad
মুর্শিদাবাদ
কাশিমবাজার ছোট রাজবাড়ির দুর্গাপুজো - দেবাশিষ বন্দ্যোপাধ্যায়
আঠারো শতকে এই রাজ পরিবার প্রতিষ্ঠা করেন অযোধ্যানাথ রায়। প্রায় দেড় দশক ধরে পুজোর ও রাজবাড়ির প্রাচীন জৌলুস ফেরানোর ব্যাপারে মনোনিবেশ করেছেন রাজবাড়ির বর্তমান বংশধর প্রশান্ত রায় ও তাঁর সহধর্মিনী সুপ্রিয়াদেবী। সুপ্রিয়াদেবী অবশ্য ‘রানিমা’ নামেই বেশি পরিচিত। মূলত তাঁর প্রচেষ্টাতে অতীতের গন্ধ আজ অনেকখানিই ফিরে এসেছে কাশিমবাজারের ছোট রাজবাড়ির পুজোয়।
পুজোর শুরু
রাজবাড়ির এই দুর্গাপুজো প্রায় ৩০০ বছরের প্রাচীন। অযোধ্যানাথ রায়-এর পৌত্র জগদ্বন্ধু রায় ছিলেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দেওয়ান। তাঁর আমল থেকে কাশিমবাজার ছোট রাজবাড়ির শ্রীবৃদ্ধির ও দুর্গাপুজোর শুরু।
পুজোর বৈশিষ্ট্য
রথের দিন কাঠামো পুজো আবশ্যিক। একচালার সপরিবার সাবেক দেবীমূর্তি। রাজবাড়ির মন্দিরে শুক্লা প্রতিপদ থেকে পঞ্চমী পর্যন্ত ৩ জন পুরোহিত চণ্ডীপাঠ করেন। ৩ জন পুরোহিত দুর্গানাম জপ করেন। আর প্রধান পুরোহিত বিল্ববৃক্ষের শাখার পুজোপাঠ করেন। ষষ্ঠীর সন্ধ্যায় দুর্গার বোধন, আমন্ত্রণ ও অধিবাস সম্পূর্ণ হয়। সপ্তমীতে ঘট ভর্তি করে মূর্তির প্রাণ প্রতিষ্ঠা করা হয়। রাজ পুরোহিত গোপাল রায় বলেন,‘‘সপ্তমী, অষ্টমী ও নবমীতে কুমারীপুজো ও সধবা পুজো হয়।”
তন্ত্র মতের এই পুজোয় আগে বলিদান প্রথা ছিল। পুরোহিত বলেন, ‘‘প্রায় ৩৭ বছর আগে রাজা কমলারঞ্জন রায়ের আমলে ঘাতকের অভাবে বলিদান প্রথা বাতিল করা হয়। সেই থেকে বলির অনুকল্প হিসাবে দেবীকে রুই মাছের ঝোল ও কাঁচা সন্দেশ নিবেদন করা হয়।”
তুলট কাগজে হাতে লেখা ৪৫ পাতার নিজস্ব পুঁথি থেকে মন্ত্র পড়ে পুজো হয়। নবমীতে পঙক্তি ভোজন ও প্রসাদ বিতরণ করা হয়। দশমীতে মহিলাদের সিঁদুর খেলা ও অপরাজিতা পুজো হয়। দশমীতে প্রতিমা নিরঞ্জনের পর রাজবাড়ির সদস্যরা নাটমন্দিরে সমবেত হন। সেখানে তাঁদের আর্শীবাদ করেন রাজ পুরোহিত।
ভোগ বিশেষত্ব
সপ্তমী, অষ্টমী ও নবমী— তিন দিনই থাকে অন্নভোগের আয়োজন। সাদা ভাতের সঙ্গে থাকে ফ্রায়েড রাইসও। ডাল-ভাতের সঙ্গে থাকে আলু, পটল, বেগুন, কুমড়ো ও বড়া মিলিয়ে পাঁচ রকমের ভাজা, আলু-কপি, অথবা আলু-পটলের দোর্মা, পাঁচ তরকারি, রুই মাছের ঝোল, শাক, চাটনি, মিষ্টি ও পায়েস। নবমীর দিন ভোগের মেনুর সঙ্গে যুক্ত হয় মোচার ঘণ্ট, লাউ-চিংড়ি ও ইলিশ মাছের ঝোল, ভাপা ও ভাজা। সন্ধিপুজোয় থাকে খিচুড়ি, আলু, বেগুন, পটল ভাজা ও মাছ ভাজা।
Durga Puja of Purulia
পুরুলিয়া
সিমলাপাল রাজবাড়ির দুর্গাপুজো - দেবাশিষ বন্দ্যোপাধ্যায়
পুজোর শুরু
প্রায় ৪০০ বছরের পুরনো পুজো। কে শুরু করেছিলেন, তা জানা যায়নি। তবে শেষ রাজা ছিলেন শ্যামসুন্দর সিংহ চৌধুরি। পুজো তাঁর সময়ের অনেক আগে থেকেই চলছে।
পুজোর বৈশিষ্ট্য
আগে পুজোয় শতাধিক ছাগশিশু বলি হত। ১৯৯৫ সাল থেকে পশু বলি পুরোপুরি বন্ধ। রাজ পরিবারের বর্তমান বংশধরেরা পশু বলির ঘোর বিরোধী। তবে পশু বলি ছাড়া পুজোর অন্যান্য নিয়ম নিষ্ঠা এখনও মেনে চলা হয়। অষ্টমীর সন্ধিপুজোর আখ বলির ধরণ একটু ভিন্ন। দেবীর থানে ত্রিভুজের আকারে আখগুলি দাঁড় করানো হয়। এর পর বলি দেওয়া হয়।
ভোগ বিশেষত্ব
বিজয়া দশমীর দিন খিচুড়ি ভোগ এলাকার সব ধর্ম ও সম্প্রদায়ের মানুষজনকে খাওয়ানো হয়।
Durga Puja of Purulia
পুরুলিয়া
হদলনারায়ণপুর গ্রামের মণ্ডল পরিবারের দুর্গাপুজো - দেবাশিষ বন্দ্যোপাধ্যায়
১৭১২ খ্রীস্টাব্দে বর্ধমানের নীলপুর গ্রাম থেকে এসে হদলনারায়ণপুরে বিষ্ণুপুরের মল্লরাজা গোপাল সিংহ’র পৃষ্ঠপোষকতায় জমিদারির পত্তন করেন মুচিরাম ঘোষ। পারুল পরগনার হদলনারায়ণপুর-সহ কয়েকটি গ্রামের ফৌজদার নিযুক্ত করা হয় তাঁকে। পরে মল্লরাজারা প্রচুর নিষ্কর জমি দিয়ে মুচিরামকে ‘মণ্ডল’ উপাধিতে ভূষিত করেন। তৈরি হয় গোল দরজা, সাত মহলা অট্টালিকা, অপূর্ব স্থাপত্যের রাস মন্দির, রথ, অভিজাত দুর্গা মণ্ডপ।
পুজোর সূচনাও ওই সময়ে। শুধু দুর্গাপুজোই নয়। রাস, রথ ও কালীপুজো পরিচালনার জন্য গঠিত হয়েছে মণ্ডল দেবত্র এস্টেট।
পুজোর বৈশিষ্ট্য
এস্টেটের অন্যতম পরিচালক ধীরাজ মণ্ডল জানান, পুরনো প্রথা মেনে বৈষ্ণব মতে পুজো হয়। পুজোর তিন দিন নিরামিষ খাওয়া হয়। দশমীতে মাছ বলির পর আমিষ গ্রহণ। এই পুজোর অন্যতম বৈশিষ্ট্য, গ্রামের পাশে দামোদরের শাখা নদী বোদাই থেকে পাল্কিতে আসে নবপত্রিকা। বিসর্জনের পরে সিঁদুর খেলায় মাতেন মেয়েরা।
ভোগ বিশেষত্ব
পরিবারের বর্ষীয়ান সদস্য দেবীদাস মণ্ডল জানান, সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয় হল পুজোর চার দিন পরিবারের সকল সদস্যের একাসনে পাত পেড়ে খাওয়া। সেই খাদ্য তালিকায় থাকে ভাতের সঙ্গে মুগের ডাল, আলু ভাজা, শুক্তো, আলু-পটল-পোস্ত, ফুলকপির তরকারি, এঁচোড়, কুমড়োর ছক্কা থেকে পোলাও, ডালপুরী। এ ছাড়াও আনারসের চাটনি, নানা মিষ্টি ও আইসক্রিম।
Durga Puja of Purulia
পুরুলিয়া
কাশীপুর রাজবাড়ির দুর্গাপুজো - দেবাশিষ বন্দ্যোপাধ্যায়
পঞ্চকোট রাজবংশের রাজা কল্যাণশেখরের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল বল্লাল সেনের পালিতা কন্যা সাধনার। বাপের বাড়িতে সাধনার দৈনন্দিন কাজের মধ্যে ছিল কুলদেবী শ্যামারূপার সেবা করা। বিয়ের পরে তাই তিনি বায়না ধরেন শ্যামারূপা দেবীকে সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার। বল্লাল সেন তাতে অনুমতি দিলেন। আর সঙ্গে দিলেন একটি কালো রঙের ঘোড়া।
পথে ক্লান্ত নবদম্পতি একটু বিশ্রামের আশায় দেবীকে একটি গুহার মধ্যে থেকে রেখে ঘুমিয়ে পড়েন। বিশ্রামের পর যাত্রা শুরু করতে গিয়ে হল বিপদ। অনেক চেষ্টা করেও দেবীমূর্তি নড়ানো গেল না। সাধনা ঠিক করলেন নিজের প্রাণ বিসর্জন দেবেন। সহধর্মিণীর কথা শুনে কল্যাণশেখরও আত্মাহুতি দেবেন বলে ঠিক করলেন।
পঞ্চকোটরাজ বংশের বর্তমান প্রজন্মের সোমেশ্বরলাল সিংহ দেওয়ের কথায়, সেই সময়েই দেবী তাঁদের দেখা দেন। কেউ আবার বলেন যখন ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন তখন স্বপ্নে দেবী তাঁদের দেখা দেন। দেবী নির্দেশ দেন, ‘‘আমি এখানেই (মোচলপুর) থাকব। নাম হবে কল্যাণেশ্বরী। আর শ্বশুরবাড়িতে ফিরে গিয়ে তুই আমার চর্তুভুজা মূর্তি প্রতিষ্ঠা করিস। ওখানে আমার নাম হবে রাজরাজেশ্বরী।’’
অষ্টধাতু দিয়ে কোন শিল্পী মূর্তি নির্মাণ করবেন তাও দেবী জানিয়ে দেন সাধনাকে। সেই সঙ্গে বলেন, ‘‘আমি ওখানে তোর পুজো নিতে যাব। মহাষ্টমীর দিন সন্ধিপুজোর সময় আমার পদচিহ্ন দেখতে পাবি।’’ তার পর দেবীকে রেখে তাঁরা দু’জনেই পঞ্চকোটে ফিরে আসেন।
শ্বশুরবাড়িতে ফিরে দেবী নির্দেশিত শিল্পীকে দিয়েই মায়ের চর্তুভুজা মূর্তি নির্মাণ করান কল্যাণশেখর। তার পর থেকে পুজোর সময় সন্ধিপুজোয় মায়ের পায়ের ছাপ পড়ত সোনার থালায় সিঁদুরের উপর। সোমেশ্বর বাবু বলেন, “তার থেকেই প্রবাদ ‘শিখরে পা’। তাই এখানে দেবীর আরেক নাম শিখরবাসিনী।”
পুজোর শুরু
বাংলায় যখন সেন বংশের রাজত্বকাল, পুজোর শুরু সেই সময় কালে। হিন্দুধর্মের উপাসক এই রাজবংশে তার আগেও পুজো হত। কিন্তু তা অনেকটা নিজেদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। পঞ্চকোটের রাজা কল্যাণশেখর সিংহ দেও-এর মাধ্যমেই পুজোর মাহাত্ম্য ছড়িয়ে পড়ে এলাকায়।
পুজোর বৈশিষ্ট্য
প্রথা মেনে কাশীপুরের দেবীবাড়িতে আজও পুজো হয়। এখানে পুজো শুরু হয় জিতাষ্টমীর পরের দিন থেকে। টানা ১৪ দিন ধরে চলে পুজো।
ভোগ বিশেষত্ব
১৪ দিন ধরেই চলে অন্নভোগের আয়োজন।
Durga Puja of Burdwan
বর্ধমান
নতুনগঞ্জের দাসবাড়ির দুর্গাপুজো - দেবাশিষ বন্দ্যোপাধ্যায়
দাস পরিবারের পূর্বপুরুষেরা দেশভাগের পরে প্রথমে নবদ্বীপ, পরে বর্ধমানে আসেন। তাঁরা একদা ছিলেন বাংলাদেশের খুলনার তালতলা গ্রামের বাসিন্দা। সেখানে কুঞ্জবিহারী দাসের আমলে শুধু সিংহবাহিনীর পুজো চলত।
পুজোর শুরু
রাধাবল্লভ জীউ মন্দিরের কাছে নতুনগঞ্জে দাসবাড়ির পুজো এবার ৫০তম বর্ষে পদার্পণ করেছে। কৃষ্ণভক্ত হরিচরণ দাস-এর সময় থেকেই এই পুজোর শুরু। পুজো হত বর্ধমানের দিঘিরপুলের ভাড়াবাড়িতে।
পুজোর বৈশিষ্ট্য
বর্ধমানের নতুনগঞ্জ বা দিঘিরপুলের বাড়িতে একক মূর্তির সঙ্গে যোগ হয় কার্তিক, গণেশ, লক্ষ্মী ও সরস্বতী। ডাকের সাজের সাবেকি একচালা মূর্তি। পুজোয় বলিদান নিষিদ্ধ। পুজো হয় বৈষ্ণব মতে।পারিবারিক এই পুজোয় প্রায় প্রতিদিনই কয়েকশো লোককে খাওয়ানোর রেওয়াজ আছে। সেই সঙ্গে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানেরও ব্যবস্থা করা হয়।
Durga Puja of Burdwan
বর্ধমান
ইদিলপুর ঘোষবাড়ির দুর্গাপুজো - দেবাশিষ বন্দ্যোপাধ্যায়
পশ্চিম বর্ধমানের ইদিলপুরে ঘোষবাড়ির পুজোমণ্ডপ দামোদর সংলগ্ন নদীবাঁধের গায়ে।
পুজোর শুরু
পশ্চিম বর্ধমানের ইদিলপুরে ঘোষবাড়ির পুজো প্রায় ২০০ বছরের পুরনো।
পুজোর বৈশিষ্ট্য
পাকা আটচালায় হয় পুজো। নদী থেকে পরিবারের মহিলাদের লালপাড় শাড়িতে দল বেঁধে ঘটোত্তোলন আর চণ্ডীপাঠ দেখতে দলে দলে স্থানীয় মানুষ ভিড় করেন দামোদরের গায়ে। পুজোর দিনগুলিতে আগে যাত্রা, থিয়েটারের আসর বসত। পর্দা টাঙিয়ে চলতো জনপ্রিয় বাংলা চলচ্চিত্রের প্রদর্শনী। নবমীতে হত মোষ বলি। এই প্রথা আজও রয়েছে। এখন বলির মহিষ অমিলের কারণে পুজোর অনেক আগে থেকে মহিষ সংগ্রহ করে সেটাকে লালন-পালন করা হয়। পরিবারের সদস্যদের অনেকেই চাইছেন এই অমানবিক প্রথা তুলে দিতে। কিন্তু পুরোহিতেরা এখনও বলি বন্ধের ‘বিধান’ দেননি।