মেদিনীপুর
কিশোরনগর গড়ের দুর্গাপুজো - দেবাশিষ বন্দ্যোপাধ্যায়
শোনা যায়, অনেক বছর আগে গভীর রাতে এক ষোড়শী মশাগাঁর খাল (বর্তমান সাতমাইল খাল) পার হওয়ার জন্য মাঝিকে অনুরোধ করে। মাঝি রাজি না হওয়ায় কিছু দূরে ছেলেদের কাছে গিয়ে ওই ষোড়শী বলে, ‘‘কিশোরনগরে আমার বাবার বাড়ি। খাল পার করে দিলে তোমরা যা চাইবে তাই দেব।’’ ছেলেরা খাল পার করে দিলে ষোড়শী বলে, ‘‘নৌকার পাশে মাটি খুঁড়লে সব জানতে পারবে।’’ এ কথা বলেই ষোড়শী অদৃশ্য হয়ে যায়। পর দিন ছেলেরা মাটি খুঁড়ে মায়ের সংকীর্তনের বই পায়। ছেলেরা তার পর রাতে মায়ের স্বপ্নাদেশ পায়, ‘‘আমার মন্দিরে বসে গান কর। আর রাজাকে বলবি মশাগাঁ খালের নীচে তামার থালায় আমার খড়্গ আছে। রাজার লোকেরা জলের নীচে নামলেই পাবে।’’ পর দিন ছেলেরা রাজাকে সব ঘটনা জানিয়ে মন্দিরে গান করতে চাইলে রাজা তাতে রাজি হলেন না। ছেলেরা মন্দিরের পেছনে পশ্চিম দিকে গিয়ে মনের দুঃখে গান জুড়তেই মায়ের মন্দিরের পুজোর ঘট আপনি আপনি পশ্চিমমুখী হয়ে যায়। সেই থেকে আজও কিশোরনগর গড়ের দুর্গাপুজোর ঘট পশ্চিমমুখী।
পুজোর শুরু
প্রায় তিনশো বছরের প্রাচীন দুর্গাপুজো। কিশোরনগর গড়ের দুর্গাপুজোর অন্যতম বৈশিষ্ট্য পঞ্চ ব্রাহ্মণের মাথার উপর স্থাপিত বেদীতে মায়ের অধিষ্ঠান। রাজবাড়ির বর্তমান সদস্য কৃষ্ণ রায় চৌধুরীর কথায়, বাংলার নবাব আলিবর্দি খাঁর অধীনস্ত জমিদার ছিলেন রাজা যাদবরাম রায় চৌধুরী। তিনিই পাঁচ ব্রাহ্মণের মাথা মাটির নীচে পুঁতে মায়ের বেদী তৈরি করেন। আজও সেই বেদীর উপর মায়ের অধিষ্ঠান।
পুজোর বৈশিষ্ট্য
কিশোরনগর গড়ে শাক্ত মতে প্রতিপদ থেকে দশমী পর্যন্ত দশ দিন ব্যাপী পুজো হয়। সপ্তমী থেকে দশমী পর্যন্ত মায়ের বেদীর পাশে শোভা পায় মশাগাঁ খাল থেকে পাওয়া সেই তামার থালা ও খড়্গ। হোমের আগুন জ্বালানো হয় সম্পূর্ণ বৈদিক মতে। সূর্যের আলোকে আতসকাচের মাধ্যমে হোমের আগুন জ্বালানো হয়। সেই সময়ে ৫টি মহিষ আর ৫১টি পাঁঠাবলির নিয়ম চালু থাকলেও বর্তমানে পশুবলি প্রথা তুলে দেওয়া হয়েছে। জীর্ণ রাজবাড়ির মতো জরাজীর্ণ মায়ের মাটির মন্দির, খড়ের আটচালা। এটা নাকি মায়েরই নির্দেশ! তাই মাটির মন্দির আর খড়ের আটচালাতেই পূজিত হচ্ছেন তিনি।
ভোগ বিশেষত্ব
এই পুজোয় সেরা ভোগ কাজু বাদামের সন্দেশ। দুই কুইন্ট্যাল কাজুর সঙ্গে উপযুক্ত পরিমাণে ছানা ও চিনি মিশিয়ে ঘরোয়া পদ্ধতিতে তৈরি করা হয় এই সন্দেশ। পুজোর দিনগুলোতে আগত দর্শনার্থীরা ৫-৩০ টাকার কুপনের মাধ্যমে এই কাজুবাদামের সন্দেশ কিনেও থাকেন। এ ছাড়া পুজোর প্রতিদিনই নিরামিষ ভোগের আয়োজন থাকে। সেখানে ভাত, ছোলা বা মুগের ডাল, নানাবিধ তরিতরকারির পদ ও ভাজাভুজি হয়ে থাকে। আগে ১০৮টি পাঁঠা ও মহিষ বলি হত, এখন এই প্রথা উঠে গেছে।
No comments:
Post a Comment